এমসি কলেজে গণধর্ষণ: বড়ভাইদের ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয় রনি

, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, হবিগঞ্জ | 2023-08-29 18:09:55

সিলেটের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনায় ইতিমধ্যে ৬ জন চিহ্নিত হয়েছেন। তারা সকলেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এমসি কলেজের এই নেক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন হবিগঞ্জের এক বখাটে। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার বাগুনিপাড়া গ্রামের শাহ জাহাঙ্গীরের ছেলে শাহ মাহবুবুর রহমান রনি। এমন নেক্কারজনক ঘটনার কারণে রনি ও তার পরিবারের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছেন এলাকার লোকজনসহ জেলাবাসী। পাশাপাশি রনিকে ধরিয়ে দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার-প্রচারণা করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষ।

অনুসন্ধানে জানা যায়- শাহ মাহবুবুর রহমান রনি শায়েস্তাগঞ্জ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে এমসি কলেজে স্নাতকোত্তর অধ্যায়নরত রয়েছে। পড়ালেখায় মেধাবী রনি ছোটবেলায় অনেকটা শান্ত স্বভাবের ছেলে ছিল। তবে কলেজে ওঠার সাথে সাথে তার স্বভাব-চরিত্রে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বিভিন্ন ধরনের নেশা, বখাটেপণা, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে এলাকায় থাকাকালীন সময় রাজনীতিতে সে ততোটা সক্রিয় ছিল না।

সিলেট যাওয়ার পর বড়ভাইদের ছত্রছায়ায় সেই রনি হয়ে উঠেন বেপরোয়া। ছাত্রলীগের সঙ্গে সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি গণধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি এম সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে তুলেছে একটি ‘গ্যাং’। যে ‘গ্যাং’য়ের অন্যতম সদস্য শায়েস্তাগঞ্জের এই বখাটে রনি। এই ‘গ্যাং’টি ছিল এমসি কলেজ এলাকার আতঙ্ক। এমসি কলেজের ছাত্রবাস ভাঙচুর ও পুড়ানোর সাথেও এই ‘গ্যাং’টি জড়িত ছিল বলে জানান শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলতেন তারা। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন সাংবাদিকদের হত্যার হুমকি দেওয়ারও।

যারা এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়েছেন তারা জানেন, বিকেলে ক্যাম্পাসের অন্যতম আতঙ্ক ‘ছিনতাই’। এমসি কলেজের ক্যাম্পাসটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় সেখানে প্রতিদিন বিকেলে অনেক মানুষ ঘুরতে যান। সেই পর্যটকদের টাকা, মোবাইল, মোটরসাইকেল, দামি হাতঘড়ি, নারীদের সোনা-গহনা ছিনতাইয়ের মূল চক্র ছিল ‘সাইফুর গ্যাং’। যার অন্যতম সহযোগী ছিলো শায়েস্তাগঞ্জের মাহবুবুর রহমান রনি।

এলাকাবাসীর দাবি রনির ওপর ভর করে তার পরিবার ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছেন। সিলেটে চাঁদাবাজি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা বাড়িতে পাঠাত রনি। এলাকায় আসলে নিজেকে অনেক বড় ছাত্রলীগ নেতা দাবি করত সে। এলাকার বখাটেদের নিয়ে বেপরোয়া চলাফেরা ও রাতে নেশার আড্ডা বসাতো। কোমরে অস্ত্র নিয়ে চলাফেরাই ছিল তার ‘লাইফস্টাইল’।

এদিকে, এমন নেক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে হবিগঞ্জের রনি জড়িত থাকায় লজ্জিত হয়েছেন জেলাবাসী। রনি ও তার পরিবারের প্রতি ঘৃণা ও নিন্দার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। পাশাপাশি রনিকে ‘কুলাঙ্গার’ উপাধি দিয়ে ধরিয়ে দিতে ফেসবুকে তার ছবিসহ স্ট্যাটাস দিচ্ছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সাধারণ মানুষ। নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন এলাকাবাসীও।

তবে রহস্যজনক কারণে রনির পক্ষে ‘সাফাই’ গাইলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আব্দুল গফফুর। তিনি বলেন, শাহ মাহবুবুর রহমান রনির বাবা শাহ জাহাঙ্গীরের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। বলতে গেলে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। আমার জানা মতে রনি ভালো ছেলে। সে অনেক মেধাবী এবং এলাকায় আসলেও অনেক শান্ত স্বভাবের ছিল। সিলেটের ঘটনাটি শুনে আমি অবাক হয়েছি। সে এমন কাজ করতে পারে না।

এলাকার যুব সমাজের দাবি, রনি এলাকায় আসলে বখাটেদের উৎপাত বৃদ্ধি পেয়ে যেত। ছাত্রলীগের ক্ষমতা দেখিয়ে সে নেশার আড্ডা বসানোসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালাতো। কেউ তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলে অস্ত্র দিয়ে হুমকি দিত।

অন্যদিকে, এমসি কলেজের গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সারা দেশ এখন তোলপাড়। দেশের মূল আলোচ্য বিষয় এখন এই ঘটনাটি। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতারে অভিযান চালালেও নিরব রয়েছে শায়েস্তাগঞ্জ থানা পুলিশ। ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টা অতিক্রম হলেও এখন পর্যন্ত রনিকে গ্রেফতার বা তার সম্পর্কে কোনো খোঁজ-খবর নিতে তার বাড়ি বাগুনিপাড়ায় যায়নি পুলিশ।

এ ব্যাপারে শায়েস্তাগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) মো. আল-মামুন বলেন, এখন পর্যন্ত সিলেট থেকে আমাদের কাছে কোনো কাগজপত্র আসেনি। তবে যেহেতু এটি জাতীয় ইস্যু সেহেতু আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করব। তাকে গ্রেফতার করতে অভিযান চালানো হবে।

উল্লেখ, শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ২০ বছরের এক তরুণী তার স্বামীকে নিয়ে সিলেটের এমসি কলেজের ক্যাম্পাসে ঘুরতে যায়। এ সময় রাত সাড়ে ৮টার দিকে কয়েকজন বখাটে তার স্বামীকে ও তরুণীকে জোরপূর্বক কলেজ ছাত্রাবাসে তোলে নিয়ে যায়। পরে স্বামীকে গাড়িতে আটকিয়ে রেখে ৫/৬ জন মিলে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করে। রাত ১০টার দিকে স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদেরকে উদ্ধার করে। পরে গুরুত্বর আহত অবস্থায় ওই তরুণীকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি সেন্টারে ভর্তি করেন। শুক্রবার রাতে ছাত্রলীগ ক্যাডার এম. সাইফুর রহমানের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের রুমে অভিযান চালিয়ে ১টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪টি রামদা, ১টি ছুরি ও জিআই পাইপ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় শনিবার সকালে শাহ পরান থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া বিষয়টি তদন্তে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে ছাত্রাবাসের দুই নিরাপত্তাকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর