কেন ঘটলো সিলেটের গণধর্ষণ?

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-29 03:05:08

সিলেটের এমসি কলেজের পরিত্যাক্ত ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে পালাক্রমে গণধর্ষণের ঘটনায় দেশব্যাপী চরম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। উত্তাল হয়ে উঠেছে সিলেট। প্রতিবাদে সরব দেশবাসী। মিডিয়া মুখর অপরাধের চুলচেরা বিশ্লেষণে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে হাজার হাজার মন্তব্য।

বার্তা২৪.কম এই স্পর্শকাতর অপরাধের ইস্যুতে কথা বলেছে তিনজন শিক্ষাবিদের সঙ্গে, যারা সমাজ, রাজনীতি, দর্শনের বিশেষজ্ঞ।সিলেটের গণধর্ষণের অন্তর্নিহিত বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে  বিশেষজ্ঞদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ‘কেন ঘটলো সিলেটের গণধর্ষণ?’ এই সমস্যার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে অনলাইন সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তাদের মতামত উপস্থাপিত হলো।

‘অপরাধীদের সঙ্গে আদর্শ, দর্শন, মূল্যবোধ, চেতনা ও কমিটমেন্টের কোনো সম্পর্ক নেই’

ড. মহীবুল আজিজ

ডিন

কলা ও মানবিক অনুষদ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সিলেটে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনা চরম নিন্দনীয় কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। কারণ, দেশের নানা স্থানে মাঝেমধ্যেই দুর্বৃত্তরা এহেন অপকর্ম করছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, অপরাধীদের অধিকাংশই তরুণ ও যুবক বয়সী। কেননা, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে এখন ২৫-৪০ বয়সের মানুষ সর্বাধিক। এই তরুণ-যুবকগণ, যত না পড়াশোনা ও দক্ষতা অর্জনে ইচ্ছুক, তারচেয়ে বেশি বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ ও কনজিউমারিজম-ভিত্তিক  সংস্কৃতি দেখে দেখে ভোগপ্রবণ বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন। তাদের যোগ্যতা থাক বা না থাক, তাদের মধ্যে প্রচণ্ডভাবে উচ্চাকাঙ্খা তৈরি হয়েছে। ফলে তারা রাজনীতির ছত্রছায়া গ্রহণ বা অপরাধ করে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা হাসিলের জন্য। এই অপরাধীদের সঙ্গে রাজনীতি, আদর্শ, দর্শন, মূল্যবোধ, চেতনা ও কমিটমেন্টের কোনো সম্পর্ক নেই। এরাই সময়ে সময়ে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজের হীন স্বার্থে ও ব্যক্তিগত সুবিধার কারণে দল বদলায়।  

অন্যদিকে, বিভিন্ন দলের অসৎ ও কুচক্রী রাজনীতিবিদগণ সংখ্যায় নগন্য হলেও ক্ষমতাবান হয়ে উঠছেন। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থে এই তরুণ-যুবকদের কাজে লাগান। এরাই তাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে তরুণ-যুবকদের বিপথগামী করেন। তরুণ-যুবকরাও ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে মাদক, ধর্ষণ বা অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হয়। ফলে ক্ষমতা ও রাজনীতির আড়ালে একটি অপরাধচক্র প্রতিষ্ঠা পায়। তারা নৃশংস অপকর্ম করতেও পিছপা হয় না।

এজন্য তরুণ-যুবকরা যেমন দায়ী তাদের পরিবার-সমাজও তেমনি দায়ী। সন্তানদের এখন পরিবারের পক্ষ থেকে সময় দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। কোচিং বা স্কুল-কলেজের নামে তারা কোথায় যায়, কি করে, মা-বাবা সে খবর রাখে না। সমাজও তার সদস্যদের সম্পর্কে অবহিত নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পেয়েছে। এমতাবস্থায় তরুণ-যুবকরা নিজের উচ্চাশা পূরণের জন্য নির্বিঘ্নে রাজনীতির ছদ্মাবরণে অপরাধচক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। কালক্রমে সে বা তারা ভয়ঙ্কর অপরাধীতে রূপান্তরিত হয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সিলেটের গণধর্ষণ কিংবা এরকমের অপরাধের ঘটনায়। 

‘গণধর্ষণকাণ্ডে রাজনীতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও বিশেষভাবে দায়ী’

ড. মাহফুজ পারভেজ

প্রফেসর,

রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

অপরাধ বিজ্ঞানীরা ধর্ষণ নামক অপরাধ কর্মের সঙ্গে পাশবিকতা ও কামপ্রবণতার সম্পর্ক পেয়েছেন, যার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতা, যেমন আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা জড়িত। বিশেষ করে, গণধর্ষণকাণ্ডে রাজনীতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও বিশেষভাবে দায়ী। সিলেটে গৃহবধূকে গণধর্ষণের অপরাধের নেপথ্যে কাজ করেছে অনেকগুলো কারণ।

সিলেট একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ এবং এমসি কলেজ একটি স্বনামধন্য প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। সেখানে একটি পরিত্যক্ত বা অব্যবহৃত আবাসিক হল দখল করে একটি নির্দিষ্ট কক্ষকে অপরাধের কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা কেমন করে সম্ভব হলো? জায়গাটি তো আকাশ থেকে পতিত হয় নি। কলেজ কর্তৃপক্ষ ছিল, আশেপাশে সমাজের মানুষজন ছিলেন এবং পুরো শহরের মতো ঐ জায়গাটিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরের বাইরে থাকার কথা নয়। সবাই যে সেখানকার অপরাধচক্র সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন, সে কথাও বলতে হবে। যদি সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আগেভাগে সতর্ক হতেন ও প্রতিরোধ করতেন, তাহলে এমন অপরাধচক্রই গড়ে উঠতে পারতো না এবং এহেন নৃশংস গণধর্ষণের ঘটনা ঘটাও সম্ভব ছিলো না।

ফলে অপরাধীদের ধরা ও শায়েস্তা করার পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অপরাধ হওয়ার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি ঠেকানোর উদ্যোগ গ্রহণ করাও অতীব জরুরি। সেটা শুধু সিলেটের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, দেশের সব জায়গার জন্যই দরকার। অপরাধ হওয়ার পর উত্তেজনা ও স্পর্শকাতরতা সৃষ্টির প্রবণতায় শরিক না হয়ে রাজনীতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে বর্জন করতে হবে, যে কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, পরিবার থেকে সকলেই।   

‘ধর্ষণের প্ররোচক বললে ভুল বলা হয় না’

ড. হেলাল মহিউদ্দিন

প্রফেসর,

সেন্টার ফর পীস স্টাডিজ ও রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সরকারে থাকা দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের একাংশ ছাত্র না হয়ে গুণ্ডা হয়, ধর্ষক হয়, ডাকাত হয়। কেন হয়? পেশির কারণে। পেশি বা ইংরেজি ‘মাসল’ মানে শুধুই কি গায়ের জোর? না, মোটেও তা নয়। এই ‘মাসল’-এর অর্থ ক্ষমতার জোর। দল ক্ষমতায়, ফলে ‘যা ইচ্ছে তাই করে পার পেয়ে যাওয়া যাবে’ বিশ্বাসের জোর। সিনিয়র নেতারা যাঁরা ছাত্রদের স্বীয় স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার করেন, তাঁদের আস্কারা ও মদদের জোর। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিরব থাকার জোর।

বেপরোয়াপনা ও ‘মাসল পাওয়ার’-এর আরো নেপথ্য কারণ আছে। তালিকা লম্বা করে লাভ নেই। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের ধর্ষণকাণ্ড লিখতে গেলে কয়েক খণ্ড গ্রন্থ রচিত হয়ে যাবে।ধর্ষণকাণ্ডের অধিকাংশই খবরে আসে না। ধর্ষিতা ভয়েই ঘটনা প্রকাশ করে না। ছিঁটেফোটা যে দুয়েকটি খবর হয়, সেগুলোই সবার চোখে পড়ে। যেমন বর্তমানে সিলেট বা আগে জাহাঙ্গীরনগরে (১৯৯৩, ১৯৯৫, ১৯৯৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (২০০০) অথবা মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের ঘটনা (২০১৭), যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দলের।

সিলেটের এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনায় এক-দুইজন নয়, নয়জন জড়িত। কতোটা সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধচক্র হলে এমনটি হওয়া সম্ভব? পত্রিকায় খবর এসেছে স্থানীয় নেতারা ধর্ষকদের পক্ষ নিয়ে আপোস রফা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেন? সরাসরি পুলিশের হাতে ধর্ষকদের তুলে দেওয়াই কি তাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল না? অর্থাৎ ধর্ষকদের মুরুব্বিদের পরোক্ষ ধর্ষক বা ধর্ষণের প্ররোচক বললে ভুল বলা হয় না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর