খুন হওয়ার ৬ বছর পর ‘মৃত’ মামুন আদালতে হাজির!

, জাতীয়

সাবিত আল হাসান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নারায়ণগঞ্জ | 2023-08-31 14:42:05

আমার পোলারে (ছেলে) কিয়ের জন্য ধইরা নিলো আমি বুঝতেই পারি নাই। ধইরা নিয়া কয় পোলায় নাকি মানুষ মারছে। ওরে নিয়া হাঁটুর নিচে লাঠি বাইন্দা ইচ্ছামতো পায়ে মারলো। যার লইজ্ঞা (জন্য) আমার পোলারে মাইরা কোমড়, পা ব্যথা বানায়া দিলো ওই পোলা ঠিকই বাইচ্চা ফিরছে। আমার পোলার ব্যথা ফিরায়া দিবে কে? কে দিব এই ক্ষতিপূরণ?

আইনজীবীর চেম্বারে বসে চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন মামলার আসামি সাগরের মা আমেনা বেগম। একদিকে দীর্ঘ ৬ বছরের মামলা থেকে নিস্তারের স্বস্তি, অন্যদিকে নিজ সন্তানকে বিনা দোষে নির্যাতিত হবার ক্ষোভ। নারায়ণগঞ্জের আদালতে জিসা মনি হত্যাকাণ্ডের পর নতুন করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে গুম খুন হয়ে থাকা ভুক্তভোগী মামুন জীবত ফিরে আসায়। অথচ মামুনের পিতা ছেলে নিখোঁজের ঘটনায় ৬ জনকে আসামি করে গুমের মামলা দায়ের করে এবং সিআইডি এই মামলায় ৬ জনকেই হত্যার আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। তবে নিহত মামুন জীবিত ফিরে আসার ঘটনা এখন নারায়ণগঞ্জের টক অব দ্যা টাউন ইস্যু।

মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী ও নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১০ মে একটি নম্বর থেকে ফোন পেয়ে মতলব থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসে মামলার প্রধান নায়ক মামুন। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। এই ঘটনায় ২ বছর পর অর্থ্যাৎ ২০১৬ সালের ৯ মে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে মামুনের পিতা আবুল কালাম। মামলায় আসামি করা হয় মামুনের সাবেক প্রেমিকা তাসলিমা, তার বাবা রকমত আলী, তার ভাই রফিক, খালাতো ভাই সোহেল, সাগর ও তার মামা সাত্তার মোল্লাকে।

এই মামলায় ৬ জনকেই গ্রেফতার করে দফায় দফায় রিমান্ডে পাঠায় পুলিশ। কিন্তু কোনো আসামিই এই মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। তবে মামলার আসামি সাত্তার মোল্লার স্ত্রী অর্থাৎ তাসলিমার মামী মাকছুদা এই মামলায় বাদী পক্ষের সাক্ষী হয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এসময় তিনি বলেন, ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকার একটি বাড়ির ১২ নং কক্ষে আসামিরা মিলে মামুনকে হত্যা করে। পরবর্তীতে সেই মরদেহ সিএনজিতে করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিয়ে আসে। তিনি নিজে তার স্বামী সাত্তার মোল্লার পরনের লুঙ্গিতে রক্তের দাগও দেখেছেন বলে আদালতকে জানান।

কিন্তু মামলার কোনো কূল-কিনারা করতে না পারায় অন্তত ৬ জন কর্মকর্তার হাতে মামলাটি বদল ঘটে। ফতুল্লা থানা থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও পরবর্তীতে সিআইডি এই মামলার তদন্তের দায়িত্ব নেন। ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর মামলার ৬ আসামিকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট প্রদান করে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন উজ্জল। এরপর ধীরে ধীরে বিচারের দিকে এগোচ্ছিলো মামলাটি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ঘটনার ৬ বছর পর আদালতে স্বশরীরে উপস্থিত হয় গুম খুন হয়ে যাওয়া সেই মামুন। সাথে সাথেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকা আসামি পক্ষের লোকজন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। টানা ৬ বছরে মিথ্যা মামলার ঘানি টানতে টানতে প্রায় সর্বশান্ত হবার পথে তারা। মামলার বাদী, তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রের কাছে এই ঘটনার ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী ও ভুক্তভোগীরা।

ভুক্তভোগী পরিবার

পিটিয়ে তাসলিমার পেটের বাচ্চা নষ্ট করে আবুল কালাম


ভুক্তভোগী তাসলিমার মা বলেন, আমাদের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে। মামুন আর আমাগো বাড়ি পাশাপাশি। মামুন হারায়া যাওনের ২ বছর আগে মাইয়ারে ফোনে বিরক্ত করতো মামুন। তখন ওরা দুজনেই ছোট ছিল। তাসলিমার তখন ১৪/১৫ বছর হইব। আমরা না করে দিসি যাতে ওরে বিরক্ত না করে। যদি বিয়া করতে চায় তাইলে আলাদা হিসাব। কিন্তু এরপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নাই আমার মাইয়ার সাথে। মামলার ৫ মাস আগে আমার মাইয়ার বিয়া হয়। একদিন এলাকা দিয়া মাইয়া আর মাইয়ার জামাই যাইতাসিলো তখন আবুল কালাম, কালামের মাইয়া, কালামের বউ মিল্লা তাসলিমা আর ওর জামাইরে ইচ্ছামত মারলো। মারার সময় কইলো আমার মাইয়া নাকি মামুনরে মাইরা ফেলসে। ওই সময় তাসলিমার পেটে বাচ্চা। মাইরের চোটে মাইয়ার বাচ্চাও নষ্ট হইয়া গেসে তখন।

মামুনের বাপে পিটানের কয়েকদিন পর মতলব থানায় যায় আমাগো নামে মামলা করতে। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয় নাই। ২ মাস পরে হেরা ফতুল্লা থানায় আইসা মামলা করছে। সেই মতলব থেইক্কা আমরা আইসা আইসা হাজিরা দিতাম। আমার মাইয়ারে রিমান্ডে নিয়ে ইচ্ছামতো মারছে। মাইয়া হাঁটতে পারতো না। ১ বছরের বেশি সময় এই মামলায় জেল খাটছে। এই বিচার এখন কে করবো? ওর বাচ্চা ফিরায়া দিতে পারবো? এই ৬ বছরের অশান্তি ফিরায়া দিতে পারবো?

এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে সোহেলের পরিবার


সোহেলের মা আমেনা বেগম এই প্রতিবেদককে বলেন, আমার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। দুই পরিবারের ঝামেলা হইসে মতলবে। আমার বোনের মেয়ে আমার বাসায় বেড়াইতে আইতেই পারে। অথচ সেই অজুহাতে আমার পোলারেও মামলায় জড়াইলো। আমার পুরো পরিবারটা ধ্বংস কইরা দিলো। জায়গা জমি বেইচ্চা এই মামলার খরচ চালাইসি। মানুষের কাছে অপদস্ত হইসি, পুলিশের ঝামেলা থিকা বাচতে বাড়ি ছাইড়া এলাকা পাল্টাইসি। আমার পোলারে রিমান্ডে নিয়া পিটায়া কোমড়, পিঠ, ঘাড় শেষ কইরা দিসে। পোলা এখন কোন ভারী কাম করতে পারে না। এই ক্ষতিপূরণ চাই আমি। আমি রক্ত বেইচ্চা হইলেও এই মামলা লইড়া ক্ষতিপূরণ আদায় করমু। আমার পোলারে যেই কয়বার পিটাইসে আমি সব উসুল তুলমু। যদি এর আগেই মইরা যাই তাইলে আল্লাহর কাছে দায়িত্ব দিয়া যামু। আল্লায় ওগো বিচার করবো।

নিজের স্ত্রী মিথ্যা সাক্ষ্য দিবে ভাবতে পারেননি সাত্তার মোল্লা।

মামলার অন্যতম সাক্ষী মাকসুদাই কেবল ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। সাত্তার মোল্লার সাথে সম্পর্ক অবনতি হওয়ায় বাদী পক্ষের প্রলোভনে পরে এই কাজ করেছে এমনটাই ধারণা সাত্তার মোল্লার। কিন্তু জবানবন্দিতে নিজ চোখে দেখতে পেয়েছে আমি নাকি মামুনরে মারছি। আমার লুঙ্গিতে নাকি মাকসুদা রক্ত দেখছে। শুইনা অনেক ঘৃণা লাগছে নিজের কাছে। পুলিশ আমারে গ্রেফতার করছে। ১ মাস পর জেল থিকা বাইর হইসি। কোনদিন ভাবতে পারি নাই আমার বউ আমার নামে মিথ্যা সাক্ষ্য দিবে। এরপরে কোনো দিন জিগাইও নাই কেন এমন কথা বললো।

জবানবন্দিতে যা বর্ণনা দিয়েছিলো মাকসুদা


মামলার সাক্ষী হিসেবে আদালতে ৬ আসামির বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিয়েছিলেন সাত্তার মোল্লার স্ত্রী মাকসুদা। তার দেওয়া জবানবন্দি হুবহু তুলে ধরা হলো।

আমার ননাসের মেয়ে তাসলিমার সাথে মামুনের সম্পর্ক ছিল। সাগর, রফিক, রকমত আলী, সোহেল, তাসলিমা ও আমার স্বামী মিলে প্রায় ২ বছর আগে ঘরের ভেতর আলোচনা করে কিভাবে মামুনকে মারবে। সেখানে আমি দাঁড়িয়ে সব শুনেছি। রাতে মামুনকে তাসলিমা ফোনে ডেকে নিয়ে আসে। এনে বিষাক্ত জিনিস খাইয়ে ছেলেটারে ক্লান্ত বানায়া ফেলে এবং পরে ছেলেটা মারা যায়। আমারে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখে। কিছুক্ষণ পর আমি জানালা দিয়া দেখি মামুনকে সিএনজিতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। রাত ৩টা বাজে তারা ফিরে আসে। আমি আমার স্বামীর লুঙ্গিতে রক্ত দেখছি। আমি জিজ্ঞাসা করায় আমারে চুপ করতে বলে। কারও কাছে কিছু বললে আমাকেও মেরে ফেলবে। আমারে প্রায় ২ বছর আটকায়া রাখছে। অনেক মারধর করছে আমাকে। আমি মামুনের বাবারে ২ বছর পর জানাইছি। তারে আমি সব বলছি যে কারা তার ছেলেরে মারছে।

ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করবেন আইনজীবী


মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমদাদ হোসেন সোহেল বলেন, আসামি পক্ষ দরিদ্র। তাদের মামলাটি আমি অনেকটা সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবেই নিয়েছিলাম। প্রথমদিকে আমি নিজে বিশ্বাস না করলেও পরে বিশ্বাস করি যে মামলাটি ভুয়া। একটি সাধারণ বিষয় যা আমাকে অবাক করেছে। ঘটনার ২ বছর পর মামলা হলেও বাদীপক্ষ এই ২ বছরে কোনো জিডি করেনি। মামলার সাক্ষী তার স্বামীর সাথে সম্পর্কহীন। এতকিছুর পরেও তাদের ৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে সিআইডি। এখন সেই ছেলে ফিরে এসেছে, কিন্তু ৬ বছরে ২০ লাখ টাকা শুধু মামলার পেছনে ব্যয় করেছে এই ৬ জন। তাদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আমি উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করবো।

ভুক্তভোগী ৬ জন জানান, বাদীপক্ষ আগেই টের পেয়ে পালিয়েছে। তারা কেবল আইনজীবী দিয়ে মামলাটি লড়ছে। বাদী আবুল কালাম ইতিমধ্যে কুয়েতে অবস্থান করছে। মামুন ফিরে আসার পর তাদের আইনজীবীর জিম্মায় ছেড়েছে আদালত। মামলাটির ভবিষ্যৎ জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট সোহেল বলেন, এই মামলাটি স্বাভাবিক ভাবেই বেশি দূর চলবে না। আগামী রোববার মামলার পরবর্তী তারিখ জানতে পারবো।

এ ব্যাপারে চার্জশিট প্রদানকারী তদন্ত কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন উজ্জলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর