রাজস্ব এড়িয়ে কৌশলে চলছে রমরমা আবাসন ‘ব্যবসা’

, জাতীয়

হাসান আদিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2023-09-01 21:27:15

রাজশাহীতে বেড়েই চলেছে জমির দাম। ইচ্ছে থাকলেও অনেকে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জমি কিনে স্বপ্নের একটি বাড়ি করতে পারছেন না। তাই তারা কিনছেন ফ্ল্যাট। দিন দিন এ শহরেও বড় হচ্ছে ডেভেলপারদের আবাসন ব্যবসা। তাদের ফ্ল্যাট বিক্রিতে সরকার পাচ্ছে রাজস্ব।

কিন্তু রাজশাহীতে ইদানীং বিভিন্ন পেশাজীবীরাও এই আবাসন ব্যবসা শুরু করেছেন। বিভিন্ন পেশার মানুষ একত্রিত হয়ে গড়ে তুলছেন বহুতল ভবন। বিক্রি করছেন ফ্ল্যাট। এসব ফ্ল্যাট কেনাবেচা থেকে পুরোপুরি রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। তাদের আর্থিক লেনদেনের কোনোরকম হিসাবই পাওয়া যাচ্ছে না।

রাজশাহী কর কমিশনারের কার্যালয়ের কর কমিশনার মুহাম্মদ মফিজ উল্যা বলেন, ডেভেলপার কোম্পানি যদি ফ্ল্যাট বিক্রি করে তাহলে অবশ্যই তার রেজিস্ট্রি হয়। রেজিস্ট্রির সময়ই সরকার রাজস্ব পায়। কিন্তু কোনো সাধারণ মানুষ বা অন্য পেশাজীবীরা যদি বহুতল ভবন করে ফ্ল্যাট বিক্রি করেন তাহলে সব সময় রেজিস্ট্রি না-ও হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, কখনো কখনো দেখা যায় রেজিস্ট্রি না করে স্ট্যাম্পে একটা লিখিত চুক্তির ওপর ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হয়। এতে রাজস্ব আদায় হয় না। এই ধরনের ফ্ল্যাট আবার ফাইলে তোলা হয় না। লুকায়িত সম্পদ হিসেবে এটা রাখার সুযোগ আছে। তবে যদি ফাইলে নথিভুক্ত করা হয় তাহলে সম্পদের ওপর কর আদায় হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহীতে চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিংবা অন্য সরকারি কোনো বিভাগের কর্মকর্তারা একত্রিত হয়ে বহুতল ভবন গড়ে তুলছেন। এসব ভবনের কিছু ফ্ল্যাট নিজের মালিকানায় রেখে বাকিগুলো বিক্রি করা হচ্ছে। এগুলো বিক্রির সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে না। যারা কিনছেন তারাও রেজিস্ট্রি করে নিচ্ছেন না। তারা শুধু স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তির ওপর ফ্ল্যাট কিনছেন। অবৈধ উপায়ে আয় করা অর্থ কাজে লাগাতে কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তা শুধু চুক্তির মাধ্যমেই এভাবে ফ্ল্যাট কিনছেন। চুক্তিপত্রে স্ত্রী বা সন্তানের নাম উল্লেখ করে ফ্ল্যাটের মালিকানা বুঝে নেয়া হচ্ছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে নগরীর ভদ্রা আবাসিক এলাকা, উপ-শহর, বিনোদপুর ও ডাবতলা এলাকায় বিভিন্ন পেশার মানুষ একত্রিত হয়ে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ করছেন। ডাবতলা এলাকার একটি ১১ তলা ভবনের নাম ‘কৃষিবিদ টাওয়ার’। চিকিৎসকরা গড়ে তুলছেন ‘ডিউড্রপ টাওয়ার’। বেশিরভাগ শিক্ষক মিলে গড়ে তুলেছেন ‘ফ্রেন্ডশিপ টাওয়ার’। এসব ভবনে কেউ কেউ একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক। একাধিক ফ্ল্যাটের কারণে কেউ কেউ বিক্রিও করছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রেজিস্ট্রি হচ্ছে না। শুধু মালিকানা বদলের চুক্তি হচ্ছে।

কৃষিবিদ টাওয়ারে কৃষি বিভাগের ২২ জন বড় কর্তার ফ্ল্যাট আছে ২৭টি। এই ভবনে শফিকুল ইসলাম নামে এক কৃষিবিদের ফ্ল্যাট ছিল। বর্তমানে তিনি ইতালিতে আছেন। সম্প্রতি আবদুল হালিম নামে আরেক কৃষিবিদের কাছে শফিকুল ইসলাম ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন। কিন্তু আবদুল হালিম ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রি নেননি। এ বিষয়ে কথা বলতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। ইতালিতে অবস্থান করায় শফিকুল ইসলামের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।

তবে এই ভবনের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ইতালিতে থাকার কারণে শফিকুল ইসলাম ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রি দিতে পারেননি। দেশে আসলে হয়তো দেবেন।

ফ্রেন্ডশিপ টাওয়ারের নিচতলায় বড় এক সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘ফ্রেন্ডশিপ টাওয়ারের ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার নীতিমালা’। কিন্তু কোথাও লেখা নেই ফ্ল্যাট বিক্রি বা কিনলে রেজিস্ট্রি করতে হবে। তবে ফ্ল্যাট বিক্রি করলে ৫০ হাজার টাকা ভবনের সোসাইটির একাউন্টে জমা দিতে হবে বলে সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা হয়েছে। শহরে বিভিন্ন পেশার মানুষ এ রকম বড় বড় আবাসিক ভবন নির্মাণ করছেন। ভবন নির্মাণের সময় তারা সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন। কিন্তু ভবন তৈরির পর ফ্ল্যাট কেনাবেচার সময় ফাঁকি দেয়া হচ্ছে সরকারি রাজস্ব।

কর কমিশনার মুহাম্মদ মফিজ উল্যা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও তারা অনেক সময় খবর পান না। ক্রেতা-বিক্রেতার একটা চুক্তির মাধ্যমেই সব হয়ে যায়। কিন্তু কেউ তাদের বিষয়ে কোনো অভিযোগ দিলে তারা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন।

এদিকে, পেশাজীবীরা এ ধরনের আবাসন ‘বাণিজ্যে’ নেমে পড়ায় ক্ষুব্ধ আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রাজশাহী রিয়েল অ্যাস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশনের (রেডা)।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান কাজী বলেন, আমরা বিগত কয়েক বছর ধরে রাজশাহী মহানগরীর আবাসন খাত উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু পেশাজীবী মানুষ এবং কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে আমাদের ব্যবসা হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের কারণে সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। অথচ একটা ফ্ল্যাটের জন্য আমরা সরকারকে কমপক্ষে তিন থেকে চার লাখ টাকা রাজস্ব দিয়ে থাকি। তাই আমরা আশা করি সরকার এ ব্যাপারে শীঘ্রই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

তিনি জানান, রাজশাহীতে বর্তমানে রেডার তালিকাভুক্ত সদস্যরা প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। রাজশাহী শহরে তাদের চলমান আবাসন প্রকল্পের সংখ্যা ১০৫টি। ফ্ল্যাট হবে প্রায় ৬০০টি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব প্রকল্পে কর্মরত আছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। পেশাজীবী মানুষের আবাসন বাণিজ্য বন্ধ না করলে তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর