হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। তবে এ বছর করোনা মহামারির কারণে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আয়োজন শারদীয় দুর্গোৎসবকে দুর্গাপূজা হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷ অর্থাৎ এবার কোনো উৎসব হবে না, শুধু পূজা হবে ৷ তবুও শরৎ ঋতুকে স্মরণীয় করতে খুলনায় শারদীয় দুর্গাপূজার সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা শুধু দেবী বরণের।
মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) খুলনার মণ্ডপে মণ্ডপে দেখা যায় শেষাংশের প্রস্তুতি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মণ্ডপ আর প্রতিমায় শেষ তুলির আঁচড় দিচ্ছেন শিল্পীরা। এবার খুলনায় ৯৭৮টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে খুলনার ৯ উপজেলায় ৮৪২টি মণ্ডপে ও খুলনা মহানগরীতে ১৩৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।
বুধবার (২১ অক্টোবর) মহাপঞ্চমীর মধ্য দিয়ে শুরু হবে দুর্গোৎসব। এরপর ২২ অক্টোবরে ষষ্ঠী ও ২৬ অক্টোবরে বিসর্জনের মাধ্যমে সমাপ্ত হবে সনাতন সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। তবে এবারের পূজায় থাকছে না জমকালো আলোকসজ্জা, মেলা, আরতি, ভীড় জমায়েত বা কোনো প্রতিযোগিতা। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই মন্দির প্রাঙ্গণ ও মণ্ডপে পালন হবে পূজার আচার-অনুষ্ঠান।
খুলনা পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্যমতে, এবছর খুলনা জেলা ও মহানগরীতে মোট ৯৭৮টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। গত বছর খুলনায় ৯৯৮টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ এবার ২০টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হবে না। এরমধ্যে খুলনা মহানগরীর ৮টি থানায় ১৩৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ডুমুরিয়া উপজেলায় ১৯৫টি, পাইকগাছা উপজেলায় ১৩৬টি, বটিয়াঘাটা উপজেলায় ১০৮টি, তেরখাদা উপজেলায় ১০১টি, রূপসা উপজেলায় ৭৩টি, দাকোপ উপজেলায় ৭০টি, দিঘলিয়া উপজেলায় ৬০টি, কয়রা উপজেলায় ৫৫টি, ফুলতলা উপজেলায় ৩২টি ও চালনা পৌরসভায় ১০টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে।
খুলনার উল্লেখযোগ্য মণ্ডপগুলো হলো, দোলখোলা, শিববাড়ী, শীতলাবাড়ি, তালতলা আর্য্য কালি মন্দির, পঞ্চবীথি, আর্য্য ধর্মসভা, বড়বাজার, কয়লাঘাট কালিবাড়ি, ওমানন্দ শিবমন্ডির, মহেশ্বরপাশা বনিকপাড়া, সাহেবের কবরখানা। এছাড়া জেলার উল্লেখযোগ্য মণ্ডপগুলো হলো, রূপসা উপজেলার দুর্জনীমহল, আইচগাতি, পিঠাভোগ, বটিয়াঘাটা উপজেলার নারায়ণপুরের মহানামা যজ্ঞাস্থলী গোপাল বাড়ি, শৈলমারী, ঝড়ভাঙ্গা, হোগলাডাঙ্গা, জলমা, ডুমুরিয়া উপজেলার আন্দুলিয়া মন্ডপ, চুকনগর মালো পাড়া, খর্ণিয়া বাজার, দাকোপ উপজেলার চালনা বাজার, বউমার গাছতলা, লাউডোব, পোদ্দারগঞ্জ, লক্ষ্মীখোলা, পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি মিলনমন্দির, পাইকগাছা বাজার, তেরখাদা উপজেলার আমতলা উত্তরপাড়া, দিঘলিয়া উপজেলার মাঝিরগাতি হাইস্কুল, গাজিরহাট, ফুলতলা বাজার বণিক সমিতি, জামিরা বাজার, মাতৃসেবা, দামোদর গাছতলা ও কয়রা উপজেলার আমাদি বাজার, চান্নিরচক, সুরখালী, মহেশ্বরীপুর, ভাগবা ও খড়িয়া। নারায়ণপুরের মহানামা যজ্ঞাস্থলী গোপাল বাড়ির পূজা মণ্ডপ। প্রায় সব মন্দিরে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ, চলছে দেবী বরণের অপেক্ষা।
পূজা উদযাপন পরিষদ খুলনা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক বাবু প্রশান্ত কুন্ডু বলেন, করোনার কারণে এবছর আমরা স্বাভাবিকভাবে উৎসব পালন করতে পারবো না। উৎসব না হলেও পূজা ঠিকই হবে। করোনাকালে পূজার অনুষ্ঠানমালায় শুধুমাত্র ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করে পূজা অর্চনা করা হবে, যা শুধুমাত্র মন্দির প্রাঙ্গণ ও মণ্ডপেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সীমিত পরিসরে পূজা উদযাপনের নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ।
এ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রতিমা তৈরি থেকে পূজা সমাপ্তি পর্যন্ত প্রতিটি মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভক্ত-পূজারি ও দর্শনার্থীদের জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা, সবার বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা, দর্শনার্থীদের মধ্যে ন্যূনতম তিন ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, পূজা মণ্ডপে নারী-পুরুষের যাতায়াতের আলাদা ব্যবস্থা করা, বেশি সংখ্যক নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক রাখতে হবে। এছাড়া সন্দেহভাজন দর্শনার্থীদের দেহ তল্লাশির ব্যবস্থা রাখতে হবে। আতশবাজি ও পটকা ফাটানো থেকে বিরত থাকতে হবে। পূজা মণ্ডপে রাখতে হবে সিসি ক্যামেরা। ভক্তিমূলক সংগীত ছাড়া অন্য কোনো গান যেন বাজানো না হয়, মাইক বা পিএ সেট যেন ব্যবহার করা না হয়, পূজা মণ্ডপে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দীর্ঘ সময় কোনো দর্শনার্থী যেন না থাকে এবং সন্ধ্যার বিরতির পর দর্শনার্থীদের প্রবেশে যেন নিরুৎসাহিত করা হয়- সেসব বিষয়ও আছে নির্দেশনায়।
মণ্ডপের প্রতিমা শিল্পীরা জানান, প্রতিবছর পূজার সময়ে কাজের চাপে আমাদের স্নান খাওয়ার সময় থাকে না। এবার একেবারেই উল্টো অবস্থা। অন্যান্যবারের চেয়ে এবারে কাজকাম অনেক কম। পূজা যেহতু স্বল্প পরিসরে হচ্ছে, তাই আমাদের বাজেটও অনেক কম। এই সময়টার জন্যই সারা বছর অপেক্ষায় থাকি। এবার শুধু একটাই প্রার্থনা, করোনা থেকে আমরা যেনো দ্রুত রক্ষা পাই।
খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতে দুর্গোৎসব পালিত হয়, সে জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রতিটি মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে নিরাপত্তার সকল বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। আশা করছি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, সৌহার্দ্য, শান্তিপূর্ণভাবে ও আনন্দমুখর পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে সকল আয়োজন শেষ হবে।
খুলনার পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বলেন, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে এবছর বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পূজা চলাকালীন সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে মোবাইল ডিউটি, স্ট্রাইকিং ফোর্স জোরদার থাকবে। নিয়মের বাইরে এবার কাউকেই কোনো ধরনের আয়োজন করতে দেওয়া হবে না । শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের লক্ষে পূজা মণ্ডপে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন, স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা, প্রয়োজনে সিসি টিভি স্থাপন, উচ্চস্বরে শব্দযন্ত্র ব্যবহার না করাসহ প্রতিমা বিসর্জনের সময়ও নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।