এনআইডির দায়িত্ব চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পর্যালোচনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ

, জাতীয়

ইসমাঈল হোসাইন রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 08:12:37

সব বয়সী নাগরিকদের তথ্য পেতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন কার্যক্রমে নিজেদের অংশের দায়িত্ব নিতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আওতায় থাকা এই অনুবিভাগের কার্ড প্রিন্টসহ নিজেদের আনুসাঙ্গিক কাজের দায়িত্ব পেলে কাজের গতি অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে, আর শৃঙ্খলা ফিরবে এই কার্যক্রমে। তবে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করেই মতামত দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

সম্প্রতি এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রমে নিজেদের অংশের দায়িত্ব চেয়ে একটি প্রস্তাব  প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাস্তবতার ভিত্তিতে এটির গ্রহণযোগ্যতাসহ সামগ্রিক বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত চেয়েছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়। পরে মতামত তৈরির জন্য অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও বিধি অনুবিভাগ) সোলতান আহ্‌মদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটি গঠনের অফিস আদেশের কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের বদলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম স্থানান্তরের চ্যালেঞ্জসমূহ নির্ণয় করা এবং মোকাবিলার কৌশল সুপারিশ করা, এরূপ স্থানান্তরে কী কী আইন, বিধি ও অবকাঠামো পরিবর্তন করা প্রয়োজন তা নিরূপণ করা এবং এ রূপান্তরে ফলপ্রসূ ফলাফল আসবে কি না তা মূল্যায়ন করা।

জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে তাদের প্রথম বৈঠক করেছে। এই কমিটি চাইলে যেকোন মন্ত্রণালয় ও উইংকে ডাকতে পারবে। ইতোমধ্যে তারা স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছে। এছাড়াও সিভিল রেজিস্ট্রেশন এন্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স (সিআরভিএস) কে ডাকা হয়েছে। গঠিত এই কমিটি এখন সংবিধান ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০সহ প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান দেখছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া প্রস্তাবে এনআইডি উইং নিয়ন্ত্রণে নয় নিজেদের কাজের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের এনআইডি আইন এবং সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে কতুটুকু ক্ষমতা দেয়া আছে সেগুলো পর্যালোচনা করছে কমিটি। তবে এনআইডি অনুবিভাগের অবকাঠামোগত অবস্থা, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এর জনবলসহ সবকিছুই বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। এই কমিটির মতামত পেলে উচ্চ পর্যায় থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।

এ বিষয়ে কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও বিধি অনুবিভাগ) সোলতান আহ্‌মদ বার্তা২৪.কমকে জানান, “সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামতের জন্য আমাকে প্রধান করে একটি কমিটি হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে ছোট আকারে প্রথম বৈঠকটি করেছি। আমাদের দেখার বিষয় হলো বিষয়টি বিধি সম্মত কিনা। আমরা জাস্ট কাজটি শুরু করেছি।”

যে কারণে এনআইডির দায়িত্ব চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়:


স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের প্রস্তাবনায় বলেছে, শুধুমাত্র স্বরাষ্ট্রের অংশটির  দায়িত্ব যেন তাদের দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তারা পাসপোর্ট ভেরিফাই করা, নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন বিষয় চেক করার প্রসঙ্গটিও গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছে।


স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র শুধু ভোটার আইডি কার্ডের বিষয় নয়। ২২ ধরনের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র কাজে লাগবে। সুতরাং এটি শুধু কোন নির্দিষ্ট সংস্থার বিষয় নয়, এখানে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থারও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ন্যাশনাল আইডিকার্ড শুধু ভোটের জন্য নয়। এই সার্ভিসে তো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্সির একসেস আছে। এটা শুধু নির্বাচন কমিশন ব্যবহার করছে তাই নয়, পাসপোর্টের কাজ হচ্ছে, ব্যাংকের কাজসহ অনেক কাজই হচ্ছে, এখানে শেয়ারিংয়ের ব্যাপার আছে। এটা শুধু নিরাপত্তার জন্য নয়, এটা মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। অনেকগুলো মন্ত্রণালয় এর সঙ্গে সংযুক্ত। এছাড়াও নির্বাচন কমিশন ১৮ বছর হলে একজনকে ভোটার করছে। কিন্তু যেকোন কাজে একজন ১০ বছর বয়সী নগরিকের তথ্যও প্রয়োজন হতে পারে।  সুতরাং যার দায়িত্ব সে নিলে কাজে শৃঙ্খলা থাকবে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলছে, যেই শিশু আজ জন্ম নিলো তার রেজিস্ট্রেশন করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। জনসংখ্যার বিষয়টি নিয়ে কাজ করে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। তবে এনআইডি সরকারের কাছে যাচ্ছে এরকম কথাটি উঠেছে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এটি নিয়ে আলাদা অথরিটি আছে। তাই  দীর্ঘমেয়াদি কি হতে পারে সেটি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। বিদেশে কিভাবে করা হচ্ছে সেটিও দেখা হচ্ছে। বিদেশে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি আছে, অথবা ইনডিভিজুয়াল অথরিটি আছে। এই অথরিটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। ফলে সবাই তাদের কাছ থেকে তথ্য নিতে পারে। এমন বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে দীর্ঘ মেয়াদে কি হবে সেভাবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের গঠিত কমিটির অন্যতম সদস্য ও যুগ্মসচিব (বিধি ও সেবা এবং আইন) শফিউল আজিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, “এনআইডির বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের বিষয়ে আমরা সবার সাথে আলোচনা করে মতামত দেবো। আমাদের মতামত দেয়ার কোন সময় বেঁধে দেয়া হয়নি। তবে স্থানীয় সরকার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিসংখ্যান বিভাগসহ অনেকেই এর সঙ্গে রিলেটেড। শুধু নাগরগরিকত্ব নয় সব কিছুতেই এটি প্রয়োজন হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে আমাদের নাগরিক নিরাপত্তা, চোরাচালন প্রতিরোধসহ অন্যান্য বিষয়ের জন্য এটি তাদের দায়িত্ব দেয়া দরকার। তারা বলছে তারা কার্ডের কাজটিসহ তাদের পার্টটি যদি তারা করতে পারে। তবে তারা বলেনি পুরোটাই তাদের দিয়ে দিতে, তারা তাদের অংশটা চাচ্ছে। আমরা সেই সমন্বয়ের কাজটিই করছি।”

"এনআইডি'র বিষয়টি  তাদের দেয়া হবে কিনা সেটি তো এখনকার বিষয় নয়। উচ্চ পর্যায় এটি সিদ্ধান্ত নেবে। তারা এনআইডির সার্ভারটি চাইলেই হবে না। কোথায় কোথায় লোকবল রিপেয়ার করবে, কিভাবে সমন্বয় করবে সেসব মিলে সব কিছু যাচাই বাছাইয়ের জন্যই আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। নইলে এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই সরাসরি দিয়ে দেওয়া হতো।"

সরকারের অধীনে গেলে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে কিনা; সে বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা যখন ইন্টিগ্রেট হবে তখন এখানে কারো একার কিছু করার সুযোগ নেই। এটা দিয়ে কিছু করতে গেলে অন্যদের কাছে হিট করবে। সিস্টেম তো কারো একার অধীনে থাকবে না। আমরা বলছি নির্বাচন কমিশনের দরকার শুধু ভোটারের বিষয়টা। লোকাল গভমেন্টের দরকার কতজনের জন্ম মৃত্যু হলো সেটা। পাসপোর্টের দরকার সে আমার নাগরিগরিক কিনা। পুলিশের দরকার তার লোকেশন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দরকার বিভিন্ন বয়সের মানুষের তথ্য। যার যার জিনিসটা সে সে দায়িত্ব নেবে। এটা কারো একার প্রোপার্টি নয়। কমিশন কমিশনের কাজটি করছে, সেটা তাদের পার্ট তারা করবে। কিন্তু এটা যাতে ইনসিকিউরড না হয়, যাতে কেউ বলতে না পারে জাল এনআইডি তৈরি হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা কিন্তু আছে, গণমাধ্যমে বিষয়গুলো আসছে।”

এনআইডিতে থাকা নিজেদের অংশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নেওয়ার প্রস্তাবকে ‘অযৌক্তিক’ বলেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।


তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, "এটা করা কোনভাবেই ঠিক হবে না। যাতে এটা জনকল্যাণমূলক কাজের বাইরে ব্যবহৃত না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কোনভাবেই এটি সরকারের কাছে হস্তান্তর করা যৌক্তিক হবে না। আমাদের কোন কারণ নেই এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার। যে উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে তার বাইরে এটা কোনভাবেই ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। তবে এনআইডির বিষয়টি আমাদের একটি বড় অর্জন, কিন্তু এটাকে বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে এক অর্থে দূষিত করা হয়েছে। আমার মনে হয় অন্যরা এটি ব্যবহার করার সুযোগ পেলে এর প্রতি যে আস্থাশীলতা, গ্রহণযোগ্যতা ও সঠিকতা সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।"


 

এ সম্পর্কিত আরও খবর