কাজ শেষ হওয়ার আগেই খসে পড়ছে সরকারি ভবনের পলেস্তারা

, জাতীয়

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 10:04:29

প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের দুর্নীতির কারণে ভোলা সরকারি কলেজে নবনির্মিত ৫তলা ভিতবিশিষ্ট চারতলা ‘একাডেমিক ভবন কাম এক্সামিনেশন হল’ পরিত্যক্ত ঘোষণা হচ্ছে। ইইডি’র প্রকৌশলীরা ভবনটির চারতলা ছাদকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। বর্তমানে ভবনটির পলেস্তারাও খসে পড়ছে। ভবনটির কাজের মান এতোই খারাপ সেখানে পাঁচ তলা করতে গেলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছেন কলেজ শিক্ষকরা।

এদিকে পুরো ভবনের কাজ শেষ না হলেও বিল ঠিকই আদায় করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

দুই বছর আগে নির্মিত ভবনটির চারতলা ছাদে নির্ধারিত মাপের চেয়ে কম রড ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি ছাদের স্লাব থিকনেস ড্রইংয়ের থিকনেস থেকে কম। এ কারণে ছাদে জোরে চলাফেরা করলে শব্দ সৃষ্টি হয়। এসব কারণে ছাদটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ অভিহিত করা হয়েছে। এ কারণে ওই ভবনে লিফটও স্থাপন করা যাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) ‘ভোলা অঞ্চল’র দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ভোলা সরকারি কলেজের একাডেমিক ভবন কাম এক্সামিনেশন হলের নির্মাণ কাজে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি সস্পর্কে আমি খুব বেশি অবহিত নই। ওই সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। আমি যতটুকু জানি, বর্তমানে ওই কাজ বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে একটা টিম এসে পরিদর্শন করেছে, সেই টিম পরবর্তীতে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। তারা যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই কাজ হবে। এটা কার গাফিলতি বা কার দায়ভার সেটা তদন্ত কমিটিই বলবে।’

 ভোলা সরকারি কলেজের একাডেমিক ভবন কাম এক্সামিনেশন হলে পলেস্তারা খসে পড়ছে।

২০১৫ সালে ভোলা সরকারি কলেজের ভবনটির পাঁচতলা ভিতবিশিষ্ট প্রথম তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজটি সম্পন্ন করে হস্তান্তর করা হয়েছিল। এরপরই ভবনটির নিম্নমানের নির্মাণ কাজ চিহ্নিত হয়। গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে ইইডি কর্তৃপক্ষ উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। ওই বছর উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজের ৪র্থ তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়। ইইডির পরিদর্শন ও তদন্ত কমিটি ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন জমা দেয়, যাতে নির্মাণ কাজে বড় ধরনের অনিয়ম শনাক্ত হয়। 

গত বছর ওই ভবনটির নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করেন ইইডির প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞ ডিজাইনার জয়নাল আবেদীন। তিনি বলেন, ‘ভবনটিকে পাঁচতলা করা যাবে না। চারতলার ছাদসহ আরও কিছু সাইড ভেঙে নতুন করে পিলার দিয়ে করতে হবে। এতে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা ব্যয় হবে। আমি ভবনটি পরিদর্শন করে কয়েকটি টেস্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু এক বছর হলো- কোনো রিপোর্ট পাচ্ছি না।’

এ ব্যাপারে ভোলা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. গোলাম জাকারিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘এখানে আমাদের কাজ হচ্ছে ভবন নির্মাণ শেষে যখন বুঝিয়ে দেবে, আমরা শুধু গ্রহণ করব। টেকনিক্যাল বিষয়তো আমরা বুঝব না।’

ভবন নির্মাণের সময় আপনাদের দৃষ্টিতে ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছে কিনা জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, ‘অবশ্যই এটা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। জানতে পেরেছি যে মানের কাজ করার কথা, সেটি করেন নাই ঠিকাদার। যেহেতু সুপারভিশনের দায়িত্ব শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের এবং নিশ্চই ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল। যখন চার তলা হয়েছে তখনই জানা গেল যে কোয়ালিটি বা যে মানের হওয়ার কথা, সেটা হয় নাই। এটা নিয়ে অনেকবারই তদন্ত টিম এসেছে। যতদূর জানি বুয়েট থেকে একটা টিম দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তারা বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে দেখেছে এটাতে অনেক কিছুই ত্রুটিপূর্ণ। আসলে সাধারণ মানেরও হয় নাই, একটা অ্যাভারেজ মানও যে থাকে সেটাও হয় নাই। বাইরে যে টাইলস লাগানো হয়েছে সেগুলো খসে পড়ছে।’

পলেস্তারা খসে পড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোলা কলেজের ভবন নির্মাণের সময় ইইডির ‘ভোলা অঞ্চল’র নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন দেলোয়ার হোসেন মজুমদার। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক (ডিপি) মামলা করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু গত বছরের শেষ দিকে তাকে মাফ করে দেয়া হয়। পাশাপাশি তাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতিও দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি ইইডির চট্টগ্রাম সার্কেল প্রধানের দায়িত্বে আছেন।

ভোলা কলেজের অবকাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে দেলোয়ার হোসেন মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত রয়েছেন এবং সামনে অনেক লোক থাকায় কথা বলতে রাজি হননি।

এদিকে সম্প্রতি শিক্ষা সচিবের কাছে দেয়া এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘দেলোয়ার হোসেন মজুমদার কুমিল্লা জেলার সহকারী প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাকে ভোলা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই আদেশে আটজন কর্মকর্তা নতুন কর্মস্থলে যোগদান করলেও দেলোয়ার হোসেন যোগদান করেননি। তিনি ২০১১ সালের জুন মাসেও কুমিল্লা জেলার সকল উন্নয়ন কাজের বিলে স্বাক্ষর করেন এবং সকল দাপ্তরিক কাজে (কুমিল্লা) তার স্বাক্ষরের কাগজপত্র বিদ্যমান আছে। ২০১১ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত কুমিল্লা জোনের যাবতীয় কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন তিনি।

অন্যদিকে সেই সময়ে ভোলা জোনের দায়িত্বে থেকে ইউনুস আলী ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত উন্নয়ন কাজের সকল বিল প্রদানসহ দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করেন। দেলোয়ার হোসেন তালুকদার ওই সময়ে ভোলা জোনের কোনো বিলে স্বাক্ষর করেননি বা তার স্বাক্ষরে কোনো বিল পাশ হয়নি। অথচ তিনি অসততার আশ্রয় নিয়ে পুরোনো তারিখে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যোগদানপত্র দাখিল করেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর