মালানি, ব্রোহি, ইশতিয়াকের সফল উত্তরাধিকারী ব্যারিস্টার রফিক

, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 15:30:13

নানা ধরনের পেশায় যুক্ত থাকেন অসংখ্য মানুষ। কিন্তু প্রবাদপ্রতিম সাফল্য ও খ্যাতি অর্জিত হয় কয়জনের? কোন কোন ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক বা আমলাকে দেশে-বিদেশের সবাই এক নামে জানে? এমন সফল মানুষ খুব কমই। অনেক অনেক বছর পর এমন একজন আসেন, যিনি পেশাকে মর্যাদাবান করেন এবং পরিণত হন আইকনে।

আইন পেশার প্রসঙ্গে বলা যায়, ভারতের রামজেট মালানির কথা। করাচি থেকে সাতচল্লিশের দেশভাগে ভারতে আসা এক সিন্ধি তরুণ রামজেট মালানি জীবনে কোন কেস হারেন নি। প্রচুর আলোচিত, জটিল, বিতর্কিত ও জনগুরুত্ব মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে তার বৌদ্ধিক অংশগ্রহণ ও অবদানে। ভারতীয় আইনের অঙ্গনে তিনি 'জীবন কিংবদন্তি' মতো থেকে রাজনীতিবিদ থেকে জনতার মানবিক-আইনগত অধিকারের পক্ষে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন।

পাকিস্তানে এ. কে. ব্রোহি ছিলেন তেমনি একজন আইনজীবী, যিনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে পালন করেন স্মরণীয় দায়িত্ব। অবিভক্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার অবদান দৃষ্টান্তমূলক।

বাংলাদেশের হাজার হাজার আইনজীবীর মধ্যে এমন ঔজ্জ্বল্য মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে দেখা গেছে। একজন ছিলেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ। তিনি মালানি, ব্রোহির মতো দেশান্তরী মানুষ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে এদেশে এসে বাস করেন পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহে। ঘটনাক্রমে তিনি ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের ছাত্র হিসেবে ছিলেন আমার পিতা কিশোরগঞ্জের প্রথম এমবিবিএস প্র্যাকটিশনার, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. এ. এ. মাজহারুল হকের সহপাঠী।

ব্যক্তিগত স্নেহের সম্পর্ক ছাড়াও ব্যারিস্টার ইশতিয়াকের সঙ্গে আমার পেশাগত কারণেও যোগাযোগ ছিল। ১৯৮৯/৯০ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনের কবল থেকে ইত্তেফাক ভবনে 'সাপ্তাহিক রোববার'কে এক ঐতিহাসিক আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে মুক্ত করেছিলেন তিনি। রোববার-এর পক্ষ থেকে সাংবাদিক শেখ মহিউদ্দিন আর আমি সে সময় তার সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ রেখেছি।

রফিক-উল হকের সঙ্গে তখনই পরিচয়। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াকের জুনিয়র। বাকীদের মতো তিনিও একজন দেশভাগের শিকারে পরিণত হওয়া মানুষ। ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে জন্ম নিয়ে তিনি ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৮ সালে এলএলবি পাস করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বার এট ল’ সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে এবং ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে আইন পেশা শুরু করেন তিনি। বর্ণাঢ্য আইন পেশায় দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর পেরিয়ে তিনি পরলোকে যাত্রা করার সময় রেখে গেছেন গৌরবের আলোকস্তম্ভ।

জাতীয় রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে তিনি ছিলেন অটল। সঙ্কটে সরব ও অগ্রণী। ওয়ান ইলেভেনের জটিল পরিস্থিতিতে এই সাহসী আইনজীবীকে চিনেছেন সকলে। টক শোতে, কোর্টের বারান্দায়, এজলাসে নিয়মিত কথা বলেছেন তিনি রাজনৈতিক অধিকারের পক্ষে। হাই প্রোফাইল মামলাগুলো তাকে ছাড়া কল্পনা করা যেতো না। ওয়ান ইলেভেনের বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি দু নেত্রীর মামলা পরিচালনা করেছেন অকুতোভয়ে।

যখন ভয়ে, আতঙ্কে কেউ এগিয়ে আসার সাহস পাননি, তখন এই ছিপছিপে মানুষটি মহীরুহের মতো দৃঢ়তায় লড়েছেন কোর্টের ভেতরে ও বাইরে। আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে আলো হাতে চলেছিলেন তিনি সে অন্ধকার পরিস্থিতিতে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমূর্তি রক্ষায় ছিলেন সোচ্চার।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইনি বিষয় নিয়েও আদালতকে সহযোগিতা করেছেন। আইনের ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও শ্রদ্ধা তাকে সর্বমহলে সম্মানীয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। তার নির্ভয়ে কথা বলা, মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধ ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৯০ সালের ৭ই এপ্রিল থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিরল ঘটনা হচ্ছে, এ দায়িত্ব পালন কালে তিনি কোন সম্মানী নেননি এবং শুদ্ধতা ও নিরপেক্ষতার অনুসরণে পেশাগত জীবনে তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দল করেননি। অথচ সকল রাজনীতিবিদের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। উপার্জিত অর্থের সিংহভাগ তিনি মানবকল্যাণে ব্যয় করেছেন এবং বহু জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন পৃষ্ঠপোষক।

ব্রিটিশ ভারতে কলকাতায় জন্ম গ্রহণকারী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের শৈশব থেকে শুরু করে শিক্ষা জীবনের প্রায় পুরোটাই পশ্চিমবঙ্গে কেটেছে। পরে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, এই চার দেশের নাগরিক হতে হয়েছে তাকে।

কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংস্পর্শে আসেন রফিক-উল হক। বেকার হোস্টেলে যে কক্ষে বঙ্গবন্ধু থাকতেন তার পাশের কক্ষেই থাকতেন তিনি। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও কারমাইকেল হোস্টেলে কিছুদিন বঙ্গবন্ধুর সহচর্যে তিনি ছিলেন। 

ছাত্র জীবন থেকেই অসামান্য মেধাবী ছিলেন রফিক-উল হক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ক্রিমিনাল ল-তে প্রথম হয়ে স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন তিনি। হিন্দু ল নিয়ে ব্যারিস্টারি পড়েছেন। সেখানেও দ্বিতীয় হতে হয়নি তাকে। সপ্তাহান্তে খণ্ডকালীন চাকরি করে ব্যারিস্টারি পড়ার খরচ চালিয়েছেন। স্বাভাবিক গতিতে তিন বছরে ব্যারিস্টারি শেষ করার কথা থাকলেও মাত্র দেড় বছরের মধ্যে সবগুলো কোর্সে পাস করেছিলেন। তাকে দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু ল পড়ানো শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পরীক্ষক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন।   

পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন রফিক-উল হক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পর পর দুবার জিতেছিলেন তিনি। সোশ্যাল সেক্রেটারি হয়েছিলেন। পরে পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। তখন ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কেন্দ্রীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি। রাজনীতির সূত্রে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে, সুযোগ পেয়েছেন একসঙ্গে কাজ করার।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বাবা মুমিন উল হক পেশায় ডাক্তার হলেও চব্বিশ পরগনা মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। কলকাতা শহরও তখন এর অন্তর্গত ছিল। তিনি চব্বিশ পরগনা জেলা মুসলিম লিগের সভাপতি ছিলেন। ডাক্তারি, জমিদারি ছেড়ে গণমানুষের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে নিঃস্ব হতে হয়েছিল তাকে।

ঢাকার ফার্মগেটে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের দাদার গড়া প্রতিষ্ঠান। ঢাকা শিশু হাসপাতাল গড়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ব্যরিস্টার রফিক-উল। এই হাসপাতালের জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। লটারির টিকিট বিক্রি করে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার খরচের বড় একটা অংশ সংগ্রহ করেন তিনি। এছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছে কোনো ফি নিতেন না বলে এই হাসপাতালের জন্য আশির দশকে ৫০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছিলেন। শিশু হাসপাতাল ছাড়াও সুবর্ণ ক্লিনিক, আদ-দ্বীন, বারডেম, আহসানিয়া মিশনি ক্যান্সার হাসপাতালসহ অনেক চিকিৎসাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। নিজের উপার্জিত অর্থে গাজীপুরের চন্দ্রায় ১০০ শয্যার সুবর্ণ-ইব্রাহিম জেনারেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন।

২০১১ সালে প্রিয়তমা স্ত্রী ডা. ফরিদা হকের মৃত্যুর পর থেকে তিনি অনেকটাই একাকী হয়ে যান। পরে নিজেও জটিল রোগে আক্রান্ত হন। তবু পেশা ও মানবকল্যাণের কাজে সাধ্যমত সচল ছিলেন তিনি। তিনি তার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে পেশার মর্যাদা ও শ্রীবৃদ্ধি করেছেন এবং দক্ষিণ এশিয়ার নমস্য আইনজীবীদের সফল উত্তরাধিকার রূপে নিজেকে উত্তীর্ণ করেছেন। বাংলাদেশের আইন-আদালতের জগতে তিনি একজন বিরল, অনন্য ও উদাহরণ স্থাপনকারী আইনজীবী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

তার সঙ্গে বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা বা সামাজিক অনুষ্ঠানে কিংবা রাজধানীর ৪৭/১ পুরানা পল্টনের ‘সুবর্ণা’ নামের ছায়াঘেরা, শীতল, ছিমছাম বাড়িতে গেলে আর দেখা হবে না। পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে তিনি আর বলবেন না, 'ইয়ং প্রফেসর, কি খবর'। কিন্তু আমি নিশ্চিত, মৃত্যুর নিস্তব্ধ-শীতল প্রহর পেরিয়ে তিনি জাগরূক থাকবেন আইন-আদালত প্রাঙ্গণে, গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় এবং মানুষের অন্তর্গত হৃদয়ের মণিকোঠায়। একজন অনন্য ও অসাধারণ ব্যারিস্টার রফিক-উল-হকের কথা বাংলাদেশ মনে রাখবে চিরকাল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর