বিলীনের পথে কবি আজিজুর রহমানের স্মৃতিচিহ্ন

খুলনা, জাতীয়

ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 21:01:07

কুষ্টিয়া: একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও গীতিকার আজিজুর রহমানের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদক’ প্রাপ্ত এই কবির মৃত্যুর ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও তার স্মৃতি সংরক্ষণ ও উপস্থাপনে নেই সরকারি বা বেসরকারি কোনো উদ্যোগ।

প্রয়াত কবি ও গীতিকার আজিজুর রহমানের ৪০তম প্রয়াণ দিবসে সরকারিভাবে কোনো অনুষ্ঠান না থাকলেও স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের আয়োজনে আলোচনা সভা, কবিতা আবৃতি ও কবর জিয়ারত ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এদিকে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে কবি ও গীতিকার আজিজুর রহমানের বাস্তুভিটা ও সমাধি চত্বর। নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে তার সমাধিস্থলসহ স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো। স্থানীয়দের অভিযোগ, কবির সমাধি চত্বর পরিষ্কার না থাকায় পাশেই মাদকসেবীদের আখড়া গড়ে উঠেছে। এছাড়া সমাধি স্থলটি গোচারণের হাটেও পরিণত হয়েছে।

অথচ এই কবি আজিজুর রহমানের রচিত প্রায় ৩ হাজারের অধিক গান এক সময় ছিল মানুষের মুখে মুখে। তার জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘ভবের নাট্যশালায় মানুষ চেনা দায় রে’, ‘আকাশের ওই মিটি মিটি তারার সাথে কইবো কথা, নাই বা তুমি এলে’, ‘পৃথিবীর এই পান্থশালায়, হায় পথ ভোলা কবি’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি’, ‘বুঝি না মন যে দোলে বাঁশিরও সুরে’, ‘দেখ ভেবে তুই মন, আপন চেয়ে পর ভালো’, ‘পলাশ ডাকা কোকিল ডাকা আমারই দেশ ভাইরে’ প্রভৃতি।

জেলা কালচারাল অফিসার সুজন রহমান জানান, কবি আজিজুর রহমানের স্মৃতি রক্ষার্থে সবচেয়ে যেটি প্রথম দরকার সেটি হল প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্র। যেমন লালন শাহের স্মৃতি রক্ষার্থে লালন একাডেমী, মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতি রক্ষার্থে মীর মশাররফ বাস্তুভিটা, তেমনি কবি আজিজুর রহমানের স্মৃতি রক্ষর্থে কোনো কিছু করা উচিৎ।

কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে কবি আজিজুর রহমানের গান অন্যের নামে গাওয়া হচ্ছে। আজিজুর রহমানের স্মৃতি রক্ষা করার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান করা হলে তার গানগুলো ধরে রাখা যেত। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

সম্রাট নামের এক স্থানীয় তরুণ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আজ আমাদের হরিপুরের কৃতি সন্তান গীতিকার, সুরকার, একুশে পদক প্রাপ্ত কবি আজিজুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। দিন যায় দিন আসে তবুও এমন একজন গুণী ব্যক্তির অস্তিত্ব হুমকির মুখে থাকলেও সেটার কোনো উন্নতি হয় না। যে সমাজে গুণীজনদের কদর নাই সেই সমাজে কোনোদিন গুণীজন জন্মগ্রহণ করবে না।’

একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি, গীতিকার ও বেতার ব্যক্তিত্ব আজিজুর রহমান ১৯১৪ সালের ১৮ অক্টোবর কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম বশির উদ্দিন প্রামাণিক, মায়ের নাম সবুরুন নেছা।

গড়াই নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য তাকে সব সময় মোহিত করে রাখত। ১৩ বছর বয়সে, ১৯২৭ সালে তিনি বাবাকে হারান। উচ্চশিক্ষা লাভের ভাগ্য না থাকলেও প্রবল ইচ্ছা ও অনুসন্ধিৎসার ফলে বহু গ্রন্থ পাঠ করে তিনি একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তিতে পরিণত হন।

সাহিত্যচর্চা শুরুর আগে নাটকে অভিনয়ে তার উৎসাহ ছিল বেশি। তিনি গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল। নাট্যদলটি নাটক মঞ্চস্থ করত শিলাইদহের ঠাকুর বাড়িতে।

এ কাজের জন্য সে সময় কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সে কালের বিশিষ্ট অভিনেতা ধীরেন দত্ত, উপেশ ঠাকুরসহ বিভিন্ন নামীদামি অভিনেতারা অংশগ্রহণ করতেন তার নাট্যদলে। সমাজসেবায় কবি ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ। ১৯৩৪ সালে তিনি তার পিতামহ চাঁদ প্রামাণিকের নামে হরিপুর গ্রামে গড়ে তোলেন চাঁদ স্মৃতি পাঠাগার। এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ বইয়ের খোঁজে আসতেন এই পাঠাগারে।

তিনি একাধারে কুষ্টিয়া হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, কুষ্টিয়া (নদীয়া) ফুড কমিটির সেক্রেটারি, বেঞ্চ অ্যান্ড কোর্ট ডিভিশনের চেয়ারম্যান, কুষ্টিয়া জেলা বোর্ড ও ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্যের পদও অলংকৃত করেছিলেন।

ছাত্র থাকা অবস্থায় মুসলিম ছাত্র আন্দোলনেও ভূমিকা রেখেছেন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি প্রায় ৩০০-এর উপরে কবিতা রচনা করেছেন। তার মধ্যে নৈশনগরী, মহানগরী, সান্ধ্যশহর, ফেরিওয়ালা, ফুটপাত, তেরশপঞ্চাশ, সোয়ারীঘাটের সন্ধ্যা, বুড়িগঙ্গার তীরে, পহেলা আষাঢ়, ঢাকাই রজনী, মোয়াজ্জিন, পরানপিয়া, উল্লেখযোগ্য।

এ কবিতাগুলো এক সময় নবযুগ, নবশক্তি, আনন্দবাজার পত্রিকা, শনিবারের চিঠি, সওগাত, মোহাম্মাদী, আজাদ, বুলবুল পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা বেতারে প্রথমে অনিয়মিত এবং পরে নিয়মিতভাবে যোগ দেন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ বেতারে চাকরিতে বহাল ছিলেন। ঢাকায় গিয়ে তিনি কবি ফররুখ আহমদের সহায়তায় বিভিন্ন শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময় কবি ফররুখ আহমদ তাকে ঢাকা বেতারে নিয়ে যান।

রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, আগুন্তক প্রভৃতি ছায়াছবিতে তিনি গান রচনা করেছেন। প্রধানত গানের ফসলেই তার শিল্পের গোলা ভরেছে। অসুস্থ হয়ে পড়ায় ১৯৭৮ সালের পর কবির হাতে তেমন আর কলম ওঠেনি। একাকী বিছানায় শুয়ে দিন কেটেছে তার।

সে সময় তিনি বিছানায় শুয়ে-শুয়ে লিখেছিলেন ‘পৃথিবীর এই পান্থশালায়, হায় পথ ভোলা কবি, জলের লেখায় বালুকাবেলায়, মিছে এঁকে গেলে ছবি’। এটাই ছিল কবির লেখা শেষ গান। অর্থাভাবে চিকিৎসাও তার ভাগ্যে জোটেনি।

১৯৭৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কবি আজিজুর রহমান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে সময় তাকে ভর্তি করা হয় তৎকালীন ঢাকার পিজি হাসপাতালে। এর ৩ দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

কবির জীবদ্দশায় তেমন কোনো সম্মাননা না পেলেও ১৯৭৯ সালে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। কিন্তু কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে কোথাও তেমন কোনো কর্মসূচি চোখে পড়ে না।

কবি রচিত জনপ্রিয় গানগুলো আজ সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই কবির গানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার জন্য এবং প্রতিবছর সরকারিভাবে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে কবি আজিজুর রহমানের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালনের জোর দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।

এ সম্পর্কিত আরও খবর