প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে চলতি বছর কৃষি আবাদ ও মৎস্য চাষে সারা দেশেই ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন কৃষকরা। বছরের শুরুতেই মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন চলাকালে ফসল উৎপাদনে যেমন ভাটা পড়েছে, তেমনি উৎপাদিত কৃষিপণ্য সরবরাহ ও বাজারজাতকরণে পদে পদে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে। লকডাউন তুলে নেওয়ার পর বন্যা, অতিবৃষ্টি, ভ্যাপসা গরমে অস্বাভাবিক হারে মাছ মারা যাওয়া ও জলাবদ্ধতায় কৃষি আবাদের পাশাপাশি মৎস্য চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
মহামারি ও দুর্যোগের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু রাজশাহীতেই প্রায় ৩১৬ কোটি টাকার ক্ষতির প্রতিবেদন করেছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। জেলায় এ বছর বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে মৎস্য চাষিরা। তাদের ক্ষতি প্রায় ১৪৬ কোটি টাকা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আমচাষিদের ১২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। আর কৃষিতে ৫০ কোটি টাকার অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন কৃষকরা।
রাজশাহী মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বন্যার কারণে জেলার ১০৭ হেক্টর পুকুরের ২৬২ মেট্রিক টন মাছ ও ৩ লাখ পোনা ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। পুকুরে অক্সিজেন স্বল্পতায় বিষক্রিয়া তৈরি হয়ে ১২ কোটি টাকার অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন মৎস্য চাষিরা। এছাড়া কোভিড-১৯ এর কারণে মাছ সরবরাহ ও বাজারজাত করতে না পেরে ১৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
মৎস্য চাষিরা বলছেন, এ বছর দুর্যোগের কবলে পড়ে তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। করোনাকালে কম দামে মাছ বিক্রি করতে হয়েছে। এছাড়া হঠাৎ করেই ভ্যাপসা গরমে পুকুরে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে মাছ মরে যায়। সেসময় পানির দরে মাছ বিক্রি করতে হয়েছে। এছাড়া অনেক মাছ ফেলেও দিতে হয়েছে। এ বছর নতুন ও ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানান তারা।
নতুন মৎস্য উদ্যোক্তা রাকিবুল হাসান জানান, এ বছর তিনি প্রায় আড়াই বিঘা আয়তনের একটি পুকুরে মাছ চাষ করেছিলেন। করোনার কারণে তিনি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। লকডাউনের সময় তার পুকুরের মাছ বিক্রি উপযোগী হয়ে গিয়েছিলো। এক রকম বাধ্য হয়েই মাছ বিক্রি করতে হয়েছিলো। কিন্তু সে সময় মাছের দাম পাননি তিনি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা জানান, এবার মাছ চাষিরা একের পর এক প্রতিকূলতায় অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। মৎস্য অফিস চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করেছেন।
১২০ কোটি টাকার আমের ক্ষতি
চলতি বছরের ২০ মে দেশের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। আমের ভরা মৌসুমে শক্তিশালী এ ঝড়ে গাছ থেকে প্রায় ১৫-১৮ শতাংশ আম ঝরে পড়ে। ন্যূনতম মূল্য ধরে জেলা প্রশাসন ক্ষতি নিরূপণ করে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায়। ওই প্রতিবেদনে জেলা জুড়ে আম্পানে ১২০ কোটি টাকার আমের ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে।
এ প্রসঙ্গে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বলেন, ঝড়ে ১৫-১৮ শতাংশ আম ঝরে পড়েছিল। জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭৮ মেট্টিক টন। সেই হিসেবে ১৫-১৮ শতাংশ ক্ষতি হারে প্রায় ৪৪ হাজার মেট্রিক টন আম নষ্ট হয়েছে। যার ন্যূনতম বাজারমূল্য ধরে প্রতিবেদন করা হয়েছিল।
কৃষি ফসলের ক্ষতি
এদিকে, করোনাকালীন সময়ে অতিবৃষ্টি ও বন্যার প্রভাবে রাজশাহীর কৃষি আবাদে ৫০ কোটি টাকার অধিক ক্ষতি হয়েছে। বন্যা ও জলাবদ্ধতায় রাজশাহীর তানোর, মোহানপুর, বাগামারা, পুঠিয়া উপজেলার কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শুধু গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বন্যা ও জলাবদ্ধতায় জেলার তানোর, মোহানপুর ও বাগামারা উপজেলার ৬ হাজার ২১৬ জন কৃষকের আবাদ নষ্ট হয়ে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকার অধিক ক্ষতি হয়েছে। এতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক কৃষক।
এসময়ে জেলার এই তিনটি উপজেলাতে ৭৭ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ করা হয়েছিলো। যার মধ্যে মোট উৎপাদন থেকে ১ হাজার ৪৯৬ দশমিক ২৬ মেট্রিক টন উৎপাদন নষ্ট হয়েছে। এছাড়া ২ হাজার ৫৬১ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদের মধ্যে ৫ হেক্টর জমির সবজি নষ্ট হয়ে যায়।
এর আগে উপজেলাতে ২৭ দশমিক ৫৮ হেক্টর জমির রোপা আউশের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ৮ হাজার ৫৮০ দশমিক ৫৬ মেট্রিক টন উৎপাদন কমেছিলো। রোপা আউশের আবাদে ৩০ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছিলো। আবাদ নষ্ট হয়ে সবজিতে ৭৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, পানবরজে ৮ কোটি ৮২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ও মরিচের আবাদে ১২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছিলো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামছুল হক জানান, এ বছর কোভিড-১৯, বন্যা, অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কৃষি অফিস কৃষকদেরকে সাধ্যমতে সহায়তা করেছে। কৃষকদের ভাসমান রোপা আমনের বীজতলা তৈরি করে ধান চাষিদের সহায়তা করা হয়েছে। বিনামূল্যে সার-বীজ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তৎপর রয়েছে কৃষি অফিস।