জননেতা আজিজুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ১ নভেম্বর

, জাতীয়

নিউজ ডেস্ক | 2023-08-27 09:46:45

বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক জননেতা অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ১ নভেম্বর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ছিলেন তিনি। তারা একই সাথে বেকার হোস্টেলে থাকতেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী হিসেবে রাজনীতি করতেন কলকাতায়। তিনি ছিলেন তুখোর মেধাবী ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন একজন নেতা। যার দুয়ার সকলের জন্যে ছিল উন্মুক্ত। ১৯২০ সালের ১ নভেম্বর তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহুকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে স্বদেশী বিপ্লবী মওলানা আকিমুদ্দিন সরকার ও মা আলেকজা নেসার কোল আলো করে জন্ম নেন তিনি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে দিনাজপুর শহরে ১৯৫২ সালে আওয়ামী লীগের প্রথম দিনাজপুর জেলা কমিটি গঠিত হয়। দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহচর হিসেবে অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমান জেলা কমিটির প্রথম সভাপতি মনোনীত হলেন। তখনকার দিনাজপুর জেলা হলো এখনকার দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং পঞ্চগড় মিলিয়ে। সে জেলার প্রথম সভাপতি ছিলেন রহিমুদ্দিন উকিল সাহেব। কিন্তু ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ছয় দফা ঘোষণার পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খানের জেল জুলুমের ভয়ে রহিমুদ্দিন সাহেব দল ছেড়ে দিলেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলীও চলে গেলেন জেনারেল আইয়ুব খানের দল পিডিবি’তে। দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ হয়ে পড়লো ফাঁকা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে রাজপথে রুখে দাঁড়ালেন জনতার অকুতভয় নেতা অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমান। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মাঠে থাকলেও, দৃশ্যত তিনি সভাপতি হয়ে উঠলেন জনমানসে।

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী তার সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র, ৫ম খণ্ডে লিখেছেন, ‘দিনাজপুর বারের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, সুলেখক, সম্পাদক, সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ, দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহম্মদ আজিজুর রহমান ‘আওয়াজ’ নামে দিনাজপুরের সাপ্তাহিক পত্রিকা বার করেন ১৯৫৫ সালে। যখন ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে বাঙালির জাতিসত্তা সৃষ্টিতে নবচেতনার উন্মেষ, রাজনীতিতে বিরোধী দলের উদ্ভব, স্বাধিকার ও সাধারণ নির্বাচনের দাবি, পাকিস্তানি স্বৈরশাসনে জর্জরিত জনজীবনে; তদুপরি বঙ্গবন্ধুর উদাত্ব আহ্বানে স্বাধীনতায় উত্তরণের সুস্পষ্ট পূর্বাভাস- এমনই এক অস্থির পরিস্থিতিতে ‘সাপ্তাহিক আওয়াজ’ জেলাবাসীর মনোভূমি সৃষ্টিতে অসাধারণ চেতনা জাগায়।’

বঙ্গবন্ধুর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রায় দুইশত মাইল বিস্তৃত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্তে টিনের চোঙ্গা হাতে ছুটে অকুতোভয় নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে ক্রমান্বয়ে দলকে চাঙ্গা করে তোলেন তিনি। জনগণও আওয়ামী লীগের ছাতার তলে এসে জমায়েত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় দিনাজপুরের নেতাকর্মীরা ভালোবেসে ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ এবং ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ তাকে দিনাজপুর জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করেন। তবে ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী কাউন্সিল অনুষ্ঠিত না হওয়ায়, পূর্বের কমিটিই দায়িত্ব পালন করে বিধায় মোঃ আজিজুর রহমান, এম,এন,এ ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন।

বাম থেকে পেছনে তাজুদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেন, এ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমান। সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মানিক মিয়া।

১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি ফেব্রুয়ারিতে জেল থেকে মুক্ত হলেন জেনারেল আইয়ুব খান বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ছুটতে শুরু করলেন পূর্ব পাকিস্তানের এ মাথা থেকে ও মাথা। অক্টোবরের ১০ তারিখে এলেন দিনাজপুর সফরে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সত্যতার নিরিখে দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করা যায়, যখন ১৯৭১ সালে প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলো, তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক নির্দেশনায় জেলায় নেতাকর্মী ও তরুণদের সংগঠিত করেন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নির্বাচিত আহ্বায়ক হিসেবে। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যদের দখলে দিনাজপুর চলে গেলে, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আঙ্গিক বদলে তাকে সভাপতি করে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় পরিষদ গঠিত হয়। (তথ্যঃ মুক্তিযুদ্ধকালীন মো. আজিজুর রহমানের শত শত লেটারহেড প্যাড, যেগুলো দ্বারা তিনি অসংখ্য নির্দেশনা জারি করেছেন।)

অতি গুরুত্বের সাথে ইতিহাস মনোযোগিদের জন্যে বলা দরকার, মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন করলে, তাকে মুক্তিযুদ্ধের ৭ নং এবং ৬ নং সেক্টর (অর্ধেক) অঞ্চলের ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার, ফ্রিডমফাইটার্স রিক্রুটিং ও লিয়াঁজো অফিসার পদে দায়িত্ব প্রদান করে। জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিব নগর সরকার কর্তৃক ৩০ আগস্ট জারি করা গোপন পরিপত্র নং: ০০০৯জি/২ অনুযায়ী মো. আজিজুর রহমানের সদর দফ্তর ছিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত তরঙ্গপুরে। কার্যত, তিনি ৭ নং এবং ৬ নং (অর্ধেক) সেক্টরের সকল মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিচালনায় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিলেন।

মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত সেই গোপন পরিপত্র অনুয়ায়ী উক্ত সেক্টরের সামরিক কমান্ডার এবং অধিনস্ত সকলের জন্যে বেসামরিক বিষয়ে তার নির্দেশ মানাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দেবার এখতিয়ার তার ছিল। সকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তার সামরিক বিষয়ে প্রদত্ত পরামর্শ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সেক্টর কমান্ডারকে জানানোর নির্দেশ ছিল। উল্লেখ্য, তিনি পশ্চিমাঞ্চল প্রশাসনিক ক জোনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কাঠামো লিখিত আছে মুক্তিযোদ্ধাদের অবিকৃত তালিকার লাল বই খ্যাত দলিলে। এটা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত আছে। সে দলিল অনুযায়ী প্রথমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম রাষ্ট্রপতি হিসেবে। প্রত্যেকের জন্যে অপরিবর্তনীয় একটি ইউনিক কোড রয়েছে। যেমন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্যে প্রথম কোড হলো ০৭০০০০০০০১। এই দলিলের ৯ নং পৃষ্ঠায় ‘স্বাধীনতার বীর সেনানী’ স্বরণীয় যারা বরণীয় যারা’ শিরোনাম অধিভুক্ত ক্রম অনুযায়ী মো. আজিজুর রহমানের কোড দুবার এসেছে। প্রথমবার পশ্চিমাঞ্চলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে ০৭০০০০০০২১ এবং পরে দিনাজপুর-২ আসনের এম,এন,এ হিসেবে ০৭০০০০০০৩৯ ।

মো. আজিজুর রহমান এম,এন,এ দিনাজপুর কেন্দ্রীয় মুক্তি-সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে জুলাই মাসে যুদ্ধ সেক্টরগুলো পূর্ণতা পাবার আগ পর্যন্ত, এ পদাধিকার বলেই বিভিন্ন নির্দেশ জারি করেছেন। এবং জুলাই মাসের পর, এ পদের সাথে যুক্ত হয় ৭ নং সেক্টর হতে ৬ নং সেক্টর এর সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার পদের দায়িত্ব।

মূলত মো. আজিজুর রহমানের নেতৃত্বের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসক মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক শাসক দেশদ্রোহীতা ও তিন হাজার লোককে গণহত্যার অভিযোগ এনে অক্টোবর মাসে সামরিক আদালতে তাকে হাজির হতে সমন জারি করে এবং পরে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) রিপোর্টে বলা হয়, ১৭ আগস্ট ১৯৭১ দুই দফায় ৩০ এমএনএ কে সামরিক আদালতে তলব। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে ঠাকুরগাঁয়ের মো. আজিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ সহযোগিতা ও ৩০০০ লোকের হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে আছে এক গর্ভবতী নারীকে হত্যার পর টুকরা টুকরা করা। এরপর গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে।’

যুদ্ধের সময়ে দেখা যায়, তিনি কয়েকদফা সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং দেশের ভেতর জুন মাসে অ্যামবুশে আটকা পরেন দিন কয়েক। ধরেই নেয়া হলো তিনি নিহত। ফলে সীমান্তে এবং রায়গঞ্জে তার গায়েবানা জানাজা পরা হয়। এর দিন কয়েক পর ভারতীয় শিখ সৈন্যরা লড়াই করে তাকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনে। তার অসীম সাহসের কারণেই তিনি একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি, নেতা, যিনি মিত্র বাহিনীর অগ্রগামী দলের সাথে যুদ্ধ করে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাওঁ প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দেন। তিনি ১৯৭১ সালে ২০ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরের গোরে শহীদ ময়দানে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর উপস্থিতিতে বিজয় উৎসব অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন। তিনি ওই অঞ্চলে শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনে নেতৃত্ব দেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অন্যতম কাণ্ডারি এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের সূর্যসন্তান, সর্বস্বত্যাগী অকুতোভয় এই জননেতা মো. আজিজুর রহমান ৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে ঘাসিপাড়াস্থ ভাড়াবাড়িতে নিভৃতে মারা যান । দিনাজপুর শহরে সোনাপীর গোরস্থান চিরনিদ্রায় শায়িত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর