করোনাকালেও আলো ছড়াচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের স্কুল

, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নেত্রকোনা | 2023-08-22 10:19:43

করোনাকালেও আলো ছড়াচ্ছে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইল বাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামে নন্দিত কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের স্কুল শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ।

২০০৬ সালে পৈতৃক গ্রাম কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মা আয়েশা ফয়েজের কথা মতো এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রত্যেক পরীক্ষায় শতভাগ সফলতা অর্জন করে আসছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রছাত্রীরা। শুধু পড়াশোনাই নয়, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

করোনাকালেও পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা। তারা নিয়মিতভাবে অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এছাড়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।

তবে বিদ্যালয়টির শ্রেণিকক্ষ সংকট ও অবকাঠামোগতসহ বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ ভবনের সম্মুখভাগ। ছবি: বার্তা২৪.কম

বিদ্যাপীঠ সূত্রে জানা গেছে, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মা আয়েশা ফয়েজের কথা অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে নিজ গ্রাম কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইল বাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে ৩ একর জায়গা নিয়ে শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ নামে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা ও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তারপর মেহের আফরোজ শাওনের করা নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয় নান্দনিক স্কুল ভবন। ভবন নির্মাণ শেষে ২০০৬ সালে মাত্র ৪৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পাঠদান কার্যক্রম।

এদিকে প্রতিষ্ঠানটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়ে এলেও দীর্ঘ এক যুগেও এমপিওভুক্ত হচ্ছিল না। অবশেষে ২০১৯ সালে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসাবে প্রতিষ্ঠানটিকে এমপিওভুক্ত করে সরকার।

শহীদ স্মৃতি ফলক। ছবি: বার্তা২৪.কম

বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে সব কিছু হুমায়ূন আহমেদ নিজেই দেখাশুনা করতেন। নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নির্দেশনা দিতেন। তিনি এ বিদ্যালয়টি নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বলতেন, ‘তোমরা দেখে নিও। এই বিদ্যালয় একদিন দেশসেরা হবে। তখন শহরের ছাত্রছাত্রীরাও এখানে পড়াশোনা করতে আসবে।’

কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউ ইয়র্কের ভ্যালভিউ হাসপাতালে মারা যান তিনি। তারপর চরম হতাশায় পড়ে বিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবুও হাল ছাড়েনি। হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণের পর প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন মেহের আফরোজ শাওন। তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসাবে মেহের আফরোজ শাওন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ ভবনের জরাজীর্ণ একাংশ। ছবি: বার্তা২৪.কম

এলাকার বাসিন্দা মজিবুর রহমান জানান, হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির পাঠদান পদ্ধতি ব্যতিক্রম। শিক্ষকরা সর্বদায়ই ছাত্রছাত্রীদের খোঁজ রাখেন। শিক্ষার্থীরা কিভাবে ভালো রেজাল্ট করবে সে চিন্তাতেই সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন তারা। তাই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বীকৃতিও পেয়েছে বিদ্যালয়টি।

শিক্ষার্থী অভিভাবক কৈলাটি গ্রামের বাসিন্দা ইসলাম উদ্দিন জানান, করোনা চলাকালেও শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করে আসছেন এবং বাড়িতে এসেও খোঁজ নিচ্ছেন। এতে ছাত্রছাত্রীদের খুবই উপকার হচ্ছে।

শহীদ ফয়জুর রহমান পাঠাগার। ছবি: বার্তা২৪.কম

স্থানীয় কুতুবপুর গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদ শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ নামে ব্যতিক্রমী এই স্কুলটি আমাদের গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার মাধ্যমে তিনি চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। স্কুলটি দেখতে প্রতিদিনই অসংখ্য লোকজন এখানে ছুটে আসছেন। স্কুলের সুন্দর ভবন। তার ভেতরে হুমায়ূন আহমেদের পিতার নামে শহীদ ফয়জুর রহমান পাঠাগার। বিশাল বড় মাঠ। মাঠের একপাশে শহীদ স্মৃতি ফলক। চারপাশের সবুজের সমারোহ যে কারো হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। হুমায়ূন আহমেদের এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা এবং স্কুলের শতভাগ ফলাফলে আমরা পুরো কুতুবপুর গ্রামবাসী গর্বিত।

শ্রেণিকক্ষের জানালা ভাঙা এবং ভবনের দেয়ালর প্লাস্টার খসে পড়ছে। ছবি: বার্তা২৪.কম

শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও আমরা বিকল্প পদ্ধতিতে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করছি। অনলাইন ক্লাস হচ্ছে নিয়মিত। এছাড়া শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের পড়াশোনার অগ্রগতি বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখছেন।

বর্তমানে বিদ্যালয়ে ৩৪৭ জন শিক্ষার্থী এবং ১৭ জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় আমাদের ৭৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে এবং জিপিএ-৫ অর্জন করেছে ২৯ জন। হুমায়ূন স্যারের নির্দেশনাগুলো আজও আমাদের কানে বাজে। আমাদের বিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা স্থাপনার সাথে স্যারের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যা সর্ব সময় আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।

শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠের মাঠ। ছবি: বার্তা২৪.কম

দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০১৯ বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্তি হয়েছে অবগত করে প্রধান শিক্ষক আরো বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে প্রতি বছরই দূর-দূরান্ত থেকে অনেক শিক্ষার্থী এসে ভর্তি হয়। বেশকিছু মেয়ে শিক্ষার্থী দূর থেকে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে। দিনদিন আমাদের ফলাফল ভালো হলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শ্রেণিকক্ষ সংকট ও অবকাঠানো সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। বিদ্যালয় মাঠটিতে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করতে পারে না। বর্ষাকালে পানি জমে। স্কুল ভবনের জানালার কাচ ভেঙে গেছে। ভবনের দেয়ালের প্লাস্টারও খসে পড়ছে। এগুলো মেরামত করা প্রয়োজন। বিদ্যালয়ে কোনো বাউন্ডারি নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য একটা হোস্টেল ভবন খুবই প্রয়োজন।

তবে সম্প্রতি স্থানীয় সংসদ সদস্য অসীম কুমার উকিল ৪তলা বিভিন্ন একটি নতুন ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং আগামী ২১ নভেম্বর নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্থও স্থাপন করা হবে বলেও জানান তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর