ইভিএমের নতুন মেশিনে থাকছে ভোটের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা

ঢাকা, জাতীয়

ইসমাঈল হোসাইন রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম | 2023-08-24 19:07:53

 


নতুন এই মেশিন হ্যাকার দ্বারা হ্যাকিং সম্ভব নয়

বায়োমেট্রিক আর স্মার্টকার্ড ছাড়া ভোটগ্রহণ সম্ভব নয়

ইভিএম মেশিন চালু করার বিষয়টি পাসওয়ার্ডের ওপর নির্ভর করবে


ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটের নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক ছিল শুরু থেকেই। হ্যাকিংসহ নানা অভিযোগে জর্জরিত এই মেশিন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই। তবে থেমে নেই নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত প্রযুক্তির মেশিন সংগ্রহ করছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন এই মেশিনে রয়েছে ভোটের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিশ্বের কোন হ্যাকার দ্বারা এটি হ্যাকিং সম্ভব নয় বলে দাবি ইভিএম সংশ্লিষ্টদের।

ইভিএম নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি উইং) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। বর্তমানে ইভিএমের সার্বিক পরামর্শক হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।

তার মতে, ইভিএমের নতুন মেশিনে ভোটারের বায়োমেট্রিক আর স্মার্টকার্ড ছাড়া কোনোভাবেই ভোট গ্রহণ সম্ভব নয়। তাছাড়া অনলাইন সংযুক্ত না থাকায় হ্যাকিংয়েরও শঙ্কা নেই।

তিনি জানান, নতুন এই মেশিনে স্ক্যানার ছাড়াও অনেক নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা। পুরো মেশিনটিই এখন অত্যাধুনিক। আমরা আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, ভারত, ব্রাজিলে ব্যবহার হওয়া ইভিএমগুলো পর্যবেক্ষণ করে তাদের সব প্রযুক্তিও এই মেশিনে যুক্ত করেছি। সে তুলনায় আমাদের মেশিন বিশ্ব মানের। আমাদের মত মেশিন সারা বিশ্বে নেই।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, নতুন ইভিএম মেশিন চালু করার বিষয়টি পাসওয়ার্ডের ওপর নির্ভর করবে। এটি ভোটের আগে কারও জানার সুযোগ থাকবে না। ভোট শুরুর আগে সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসারের মোবাইল ফোনে এসএমএস এর মাধ্যমে ওই পাসওয়ার্ড পৌঁছে যাবে। ফলে ওই অনুমোদিত ব্যক্তির বাইরে কেউ এটি চালু করতে পারবেন না। তবে প্রথম ব্যক্তি কেন্দ্রে উপস্থিত হতে না পারলে দ্বিতীয় নির্ধারিত ব্যক্তির মোবাইল ফোনে পাসওয়ার্ড পৌঁছে দেওয়া হবে।

এছাড়াও ভোটের সময় ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে ভোটার শনাক্ত করা হবে। কোনও ভোটারের ফিঙ্গার প্রিন্ট মিললেই তার ব্যালটটি আনলক হবে এবং সেটি প্রদান করা যাবে। ফলে জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। আর সাধারণত কোনও ডিভাইস ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকলে সেটি হ্যাক হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। কিন্তু ইভিএম মেশিনটি ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। এর পরিবর্তে ইসির নিজস্ব নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা Nationwide Private Network (NPN) এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। ভোট 'কাউন্টিং' হবে সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ফলে এটি কারও হ্যাক করার সুযোগ নেই। নতুন ইভিএমে ভোট শুরুর আগে-পরে শূন্য ভোটিং, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফল প্রিন্ট, ঘোষণা ও বিতরণ করার ব্যবস্থাও রয়েছে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এনআইডির ডিজি বলেন, ইভিএমে কোনভাবেই একাধিক ভোট দেয়া সম্ভব না।  একটি বুথে সাধারণত সাত আটটি মেশিন থাকে। এগুলো একসঙ্গে ভোটের আগে কেন্দ্রে চলে যাবে। ভোটের দিন সকালেই ভোটারের তথ্য সম্বলিত কার্ডটি কেন্দ্রে পৌঁছে যাবে, যাতে ওই কেন্দ্রের সকল ভোটারের তথ্য রয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শুরুতেই পোলিং এজেন্টদের দেখিয়ে পাসওয়ার্ড দিয়ে ইভিএম মেশিনটি খুলবেন। এরপর ভোটার আসলে প্রথমে তার পরিচয়পত্রটি দেখবেন। প্রত্যেক ভোটারের আলাদা একটি করে সিরিয়াল নাম্বার থাকবে। ভোটার ইভিএম মেশিনে তার ফিঙ্গার প্রিন্ট দিলে তার জন্য নির্দিষ্ট করা ব্যালটটি আনলক হবে। এরপর সে সেই ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। তিনি ছাড়া এই ভোট আর কারও দেয়ার সুযোগ নেই। ভোটগ্রহণ শেষে প্রিজাইডিং অফিসার সহজেই ভোটের সার্বিক ফল প্রকাশ করতে পারবেন।

ভোট নিয়ে কোন অভিযোগ থাকলে গেজেট প্রকাশের দুই মাসের মধ্যে প্রার্থী মামলা করতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভোটাররা ভোট দেওয়ার পর তার তথ্য একইসঙ্গে মেশিনের অভ্যন্তরীণ ডাটা সেন্টারে সংরক্ষণ হবে। একইসঙ্গে মেশিনে যুক্ত এক্সটার্নাল চিপসেও তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা আছে। এই তথ্য আমরা এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করে থাকি। ভোটের বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে কেউ যদি আদালতে যায়, তাহলে আমরা আদালতে চিপস উপস্থাপন করব। সেটি যাচাই বাছাই করলেই বোঝা যাবে ভোটে কোন জালিয়াতি হয়েছে কিনা।

জানা গেছে, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) মাধ্যমে মেশিনগুলো তৈরি করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে যে ২৫৩৫টি ইভিএম ক্রয়ের সিদ্ধান্ত ছিল তার মধ্যে ৩৮০টি ইভিএম আগেই হাতে পেয়েছিল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি আরো ৬০০ সেট মেশিন হাতে পেয়েছে কমিশন। আগের মেশিনগুলো দাম ছিল ৪৬ হাজার টাকা। কিন্তু নতুন মেশিনগুলোর প্রতিটির দাম পড়ছে গড়ে প্রায় ২ লাখ টাকা।

আগের মেশিনের চেয়ে নতুন মেশিনের দাম কয়েকগুণ বেশি, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, আগের ইভিএমগুলোর প্রতিটি মেশিনের দাম ছিল ৪৬ হাজার টাকা, আর নতুন মেশিনগুলো দুই লাখ টাকা। নতুন ইভিএমে মাদারবোর্ড থেকে শুরু করে সবকিছুই অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ইভিএমে নতুনভাবে অনেক কিছুই যুক্ত করা হয়েছে। ধরুন, চায়নার ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার দাম ১১ হাজার টাকা, ইতালির স্ক্যানার ২৮ হাজার। কিন্তু আমেরিকার স্ক্যানার ৩৭ হাজার। তো আমরা সবচেয়ে ভালো মেশিনই ব্যবহার করেছি। সে কারণেই দামটা একটু বেশি পড়ছে। আমরা টেকসই একটি মেশিন তৈরি করতে চাই। এমন মেশিন তৈরি করতে চাই না, যে এক বছর পর ফিঙ্গার প্রিন্ট কাজ করবে না। আমাদের বিশ্বাস দুই থেকে তিন বছর পর ৯৯ ভাগ মানুষ বলবে আমরা ইভিএম ছাড়া ভোট দেবো না।

এই শীর্ষ কর্মকর্তা মেশিনটি শতভাগ নিরাপদ উল্লেখ করে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, ইভিএমের মেশিনটি হ্যাক করতে বিশ্বের যতো হ্যাকার আছে নিয়ে আসুন। আমরা প্রমাণ করতে চাই যে এটা কেউ হ্যাকিং করতে পারে কিনা। দেশে সাফল্য পেলে বিশ্বমানের এই ইভিএম ভবিষ্যতে দেশের বাইরেও রপ্তানি করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

নির্বাচনগুলোতে ইভিএমের ব্যাপকতা বাড়াতে দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য তিন হাজার ৮২৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন।  ‘নির্বাচন-ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্প এটি। চলতি সপ্তাহে এ সংক্রান্ত প্রকল্পটি একনেকে উঠবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এদিকে ইভিএমের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে বড় পরিসরে ঢাকায় ইভিএম মেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যে মেলা উপলক্ষে কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে ইসি। দুই দিনব্যাপী ইভিএম মেলায় লোকসমাগম ঘটাতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে ওই কমিটি। ইভিএমের এই প্রদর্শনীতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর