নওগাঁর ঐতিহাসিক দুবলহাটি রাজবাড়ি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে

, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নওগাঁ  | 2023-08-31 13:09:35

সৃষ্টি এবং ধ্বংসের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের পৃথিবী। কেউ নতুন কিছু গড়ছে, আবার কেউবা মেতে উঠছে ধ্বংসলীলায়। কিছু দায়িত্বহীন মানুষের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর নানা ঐতিহাসিক অতীত। যেকোনো জাতির সোনালী ইতিহাসগুলো সেই পুরো জাতিকে আরো ভালো ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রাণিত করে। তাই বর্তমানের ন্যায় অতীতের প্রয়োজন কোনোভাবেই কম নয়। আমাদের বাংলাদেশ জুড়েও রয়েছে এমন বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান। নানান জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্নগুলো। তার মধ্যে অন্যতম একটি ঐতিহাসিক স্থানের নাম হলো নওগাঁর দুবলহাটি রাজবাড়ি।

নওগাঁ জেলার দুবলহাটি ইউনিয়নে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি। নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে এর অবস্থান। জমিদার বাড়িটি প্রায় দুইশ’ বছরের পুরোনো। বাংলাদেশের অন্যান্য জমিদার বাড়ির তুলনায় এটি বেশ বড়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এক সময়ের এই বিলাস বহুল স্থাপনার এখন সংকটাপন্ন অবস্থা। প্রাসাদটির অবস্থা বর্তমানে এতটাই খারাপ যে যেকোনো সময় এটি বিধ্বস্ত হতে পারে।

১৭৯৩ সালে রাজা কৃষ্ণনাথ এই অঞ্চলটিতে শাসনকার্য শুরু করেন। তিনি তৎকালীন বৃটিশ লর্ড কর্নওয়ালিসের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪৯৫ টাকায় জায়গাটি কিনেছিলেন। রাজা কৃষ্ণনাথের কোনো সন্তান বেঁচে না থাকায় তার নাতি রাজা হরনাথ রায় ১৮৫৩ সালে সেখানকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রাজা হরনাথের শাসনামলে দুবলহাটি সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয়। দুবলহাটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে তিনি বিভিন্ন নাট্যশালা এবং স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন, প্রাসাদের পাশ্ববর্তী অঞ্চলে সাধারণ মানুষদের পানির চাহিদা পূরণ করতে পুকুর খনন করেন। ১৮৬৪ সালে জমিদার পরিবারের উদ্যোগে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে বিদ্যালয়টির নামকরন রাজা হরনাথের নামে করা হয়। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের পর রাজা হরনাথ ভারতে চলে যান। কিন্তু এক গৌরবান্বিত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে প্রাসাদটি।

প্রাসাদের মূল ফটকে রোমান ঘরানার পিলার চারটি তখনকার রাজাদের রুচিশীলতা বহন করে। প্রাসাদটি মোট সাতটি আঙ্গিনা ও তিনশ কক্ষ নিয়ে গঠিত। এর ভিতরের দালানগুলো তিন থেকে চার তলা বিশিষ্ট। রাজা রাজেশ্বরী নামে সেখানে একটি মন্দির রয়েছে যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হতো। প্রাসাদের ভিতরে এখনো একটি কূপ রয়েছে। রাজবাড়ির সামনে গোবিন্দ পুকুর নামে একটি পুকুর ছিল। লোকজনকে আনন্দ দানের জন্য পুকুরের পাশেই গান বাড়ি নামক একটি ঐতিহ্যবাহী দালান ছিলো যেখানে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতসাধনা করা হতো। গান বাড়ির শেষ সীমান্তে একটি কালি মন্দির ছিল যেটি এখন আগাছায় ভরপুর। কালি মন্দির থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে রাজার বাগান বাড়ি ছিল। প্রাসাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানকোঠাগুলো ইঙ্গিত করে যে দুবলহাটি সাম্রাজ্য পূর্ববর্তী যুগ কতটা সমৃদ্ধশালী ছিলো। রাজ্যটির সম্প্রসারনে এই পরিবারটির বিশাল প্রভাব ছিল। মোঘলরা হরনাথ রায় চৌধুরীকে ‘রাজা’ এবং তার পূর্ব পুরুষদের ‘জমিদার’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, দুবলহাটির জমিদারি রাজবংশের জগতারণ একজন লবন ব্যবসায়ী ছিলেন। যিনি দুবলহাটির পাশের গ্রামে ব্যবসার জন্য এসেছিলেন এবং বিল অঞ্চল লিজ নিতে শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে তারা অনেক জমির মালিক হন। বলা হয় যে, যেহেতু ওই অঞ্চলে কোনো শস্য ছিল না, তাই কই মাছ দিয়ে কর পরিশোধ করা হতো। বর্তমানে রাজবাড়িটির অবস্থা ভীষণ দুর্দশাগ্রস্ত।

জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর বাংলাদেশ প্রত্নতাত্তিক বিভাগ রাজবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে তারা একে টিকিয়ে রাখতে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। বর্তমানে ঐতিহাসিক এই স্থানটিকে স্থানীয় মাদকসেবীরা তাদের আড্ডাখানা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া এটি অসামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতেও পরিণত হয়েছে। যদিও তারা দর্শনার্থীদের কোনো ক্ষতি করে না তবুও এরা ভ্রমণকারীদের সহজ চলাফেরার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।  দালানকোঠাটির কোনো দরজা ও জানালা এখন আর নেই। এমনকি লোকজন এখন দালান থেকে ইটও খুলে নিতে শুরু করেছে। ভূমিকম্পের একটি মৃদু ধাক্কাই এর ভেঙে পড়ার জন্য যথেষ্ট। দালানটির দ্বিতীয় তলায় ওঠাটা খুবই ঝূঁকিপূর্ণ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক প্রাসাদটির পশ্চিম দিকের একটি অংশ দু’বার ভেঙে পড়েছে। প্রাসাদটির দেখাশুনা করার মত কেউ নেই এখন। যার ফলে ঐতিহাসিক প্রাসাদটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর