ভাসমান বাজারে এখন আমড়ার রাজত্ব

বরিশাল, জাতীয়

সিদ্দিকুর রহমান, ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 13:18:28

বরিশাল: সকাল পৌনে ৮টা। আশপাশের ছোট ছোট খাল থেকে আসতে শুরু করেছে ডিঙি নৌকা। কয়েকটি খালের মোহনায় ভিমরুলীর ভাসমান বাজার নামক স্থানে জড়ো হচ্ছে তারা। প্রতিটি নৌকায় আমড়া, পেয়ারাসহ নানা ধরনের সবজিতে ভরপুর। আর খালের দুই পাশেই বড় বড় ইঞ্জিনের নৌকা নিয়ে বসে রয়েছে পাইকাররা। একটু পরেই পাইকারের ডাকাডাকি ও বিক্রেতাদের দরকষাকষিতে শুরু হয়ে গেল ভাসমান এই বাজার। আর প্রতিদিনের চিত্রই এটি। সকাল ৮টা থেকে সর্বোচ্চ বেলা ১২টা পর্যন্ত চলে এই ভাসমান বাজার।

দেশে-বিদেশে বর্তমানে এই ভাসমান বাজারটি পেয়ারার বাজার নামে খ্যাত। শুধুই কী পেয়ারা? আমড়া, কলা, ডাব, লেবু, কচু কী নেই! তবে বছরের অন্যান্য সময়ের থেকে পেয়ারার মৌসুমে বেশি জমজমাট থাকে এই বাজার। আর বর্তমানে পেয়ারার মৌসুম একদম শেষ পর্যায়ে। তাই ভাসমান বাজারে এখন পেয়ারার থেকে আমড়ার আমদানিই অনেক বেশি।

জানা গেছে, ভিমরুলীর এই ভাসমান বাজারটি বাংলাদেশেরও বৃহত্তম বাজার। তাছাড়া ভিমরুলী ও আশপাশের মানুষের হাট-বাজার থেকে শুরু করে ব্যবসা-জীবিকা সবকিছুই নদী আর খাল নির্ভর। তাই আদি যুগ থেকেই অকৃত্রিম ভাবেই ঝালকাঠি, স্বরূপকাঠি ও পিরোজপুরের হাজার হাজার একর জায়গাজুড়ে উৎপাদিত পেয়ারা-আমড়ার পাইকারি বেচাকেনার জন্য গড়ে উঠে এই ভাসমান বাজার।

শুধুমাত্র পর্যটনের আকর্ষণে নয়, এটা স্থানীয় বাসিন্দা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দৈনন্দিন জীবিকার একমাত্র উৎস। আর সারাবছরই এই বাজারে চলে বেচাকেনা।

মঙ্গলবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পুরো এলাকাজুড়ে খালের চারপাশে রয়েছে পেয়ারা-আমড়ার বাগান, নার্সারি আর সবুজ প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। যা দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় করেন সাধারণ দর্শনার্থীরা। তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় পেয়ারার সময়ই বেশি তারা দলে বেঁধে ছুটে আসে নৌকা এবং ট্রলারে। ছুটির দিনে এখানে উপচেপড়া ভিড় থাকে। ওই সময়ে স্থানীয় কৃষকদের বেচাবিক্রিও অন্যান্য দিনের তুলনায় ভালো হয়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশালের বানারীপাড়া, পিরোজপুরের নেছারাবাদ এবং ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভিমরুলীর বিস্তীর্ণ এলাকায় পেয়ারা-আমড়া উৎপাদনের ইতিহাস প্রায় আড়াইশ বছরের। নিচু জমিতে উঁচু আইল কেটে সেই আইলের উপর সারি সারি পেয়ারা-আমড়া, নার্সারি এবং বিভিন্ন সবজির চাষ করেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ।

তাছাড়া দেশের মানুষের জন্য পেয়ারা এবং আমড়াসহ বিভিন্ন সবজির উল্লেখযোগ্য অংশের জোগান দেওয়া হয় এই ভাসমান বাজার থেকে।

ভিমরুলী বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল ছালেক তালুকদার বলেন,‘চল্লিশ বছর ধরে এই ভাসমান বাজারে আমড়া ও পেয়ারার ব্যবসা করে আসছি। ছোট ছোট নৌকা থেকে ওই সকল পণ্য কিনে ঢাকা, ফেনী ও চট্টগ্রাম শহরে সরবরাহ করে থাকি।’

তিনি আরও জানান, বর্তমানে পেয়ারা মৌসুম শেষ। আর এখন আমড়ার চাহিদা অনেক। তবে কিছু কিছু কৃষকের সামান্য পেয়ারা রয়েছে। কিন্তু তার দাম মৌসুমের তুলনায় তিনগুণ। বর্তমানে প্রতি মণ পেয়ারা ১ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করছেন। মৌসুমে যা ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা দামে ক্রয় করতেন। আর বর্তমানে আমড়া প্রকারভেদ অনুযায়ী মণ প্রতি ৬২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১০০ টাকা দামে ক্রয় করছেন।

এছাড়াও এই ভাসমান বাজারে লেবু, কলা, ডাব, কাঁকরোল, কচু বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। আর পণ্যের চাহিদার উপর নির্ভর করেই প্রতিনিয়ত দাম ওঠানামা করছে।

স্থানীয় বাসিন্দা রঞ্জন জানান, ভিমরুলীর এই ভাসমান বাজার যুগ যুগ ধরে চলে এলেও আগে দূর-দূরান্তের মানুষ এ বিষয়ে জানত না। কিন্তু বর্তমানে এই ভাসমান বাজারে সারা বছরই পর্যটক আসে। তবে আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাসে পর্যটকের উপচেপড়া ভিড় থাকে। আর পর্যটক আসার কারণে এ অঞ্চলের মানুষ খুবই উপকৃত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাড়তি গতি আসছে।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে এই স্থানটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখানে নেই কোনো পর্যাপ্ত সুবিধা। তাছাড়া আগত দর্শনার্থীদের থাকারও কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই সরকার যদি রাস্তাগুলো সংস্কার এবং একটি রেস্ট হাউসের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে পর্যটকরা আরও স্বস্তি পাবেন। আরও বেশি মানুষ এখানে বেড়াতে আসবে। এতে এ অঞ্চল আরও সমৃদ্ধশালী হবে।

উল্লেখ, শুধুমাত্র ভিমরুলীতেই নয় স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানা গ্রামের খালেও বসে এই ভাসমান বাজার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর