চিনিকল বন্ধ, চলছে অবৈধ মাড়াইকলে গুড় তৈরির উৎসব

, জাতীয়

আমিনুল ইসলাম জুয়েল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রংপুর | 2023-08-29 02:02:56

লোকসানের বোঝা কমাতে সরকারি সিদ্ধান্তে রংপুরের শ্যামপুর চিনিকলসহ দেশের ছয়টি চিনিকল ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।  ফলে মাঠে পড়ে থাকা আখ নিয়ে চাষিরা পড়েছেন নানা রকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে। এ পরিস্থিতিতে একটি চক্র  উৎপাদিত আখ নিয়ে চাষিদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।

তারা চাষিদের ভুল বুঝিয়ে চিনিকলের আওতাভুক্ত এলাকায় অবৈধভাবে পাওয়ার ক্রাশার মেশিন (মাড়াইকল) বসিয়ে গুড় মাড়াইয়ের উৎসবে মেতেছেন। অথচ সরকারি নির্দেশনা আছে চিনিকলের আওতাভূক্ত এলাকায় গুড় মাড়াই করা যাবে না। এর পরেও  রংপুর সদর, বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর ও পার্শ্ববর্তী দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ এলাকায়  অন্তত দেড়শতাধিক আখ মাড়াইকল গড়ে উঠেছে। সরকারি বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে দিনরাত সমান তালে চলছে আখ মাড়াই।

চাষিরা জয়পুরহাট চিনিকলের জন্য আখ না দিয়ে অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছে

শুক্রবার (২২ জানুয়ারি) রংপুরের বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা ও যমুনেশ্বরী নদীর চর ঘুরে দেখা গেছে, চাষিরা জয়পুরহাট চিনিকলের জন্য আখ না দিয়ে অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছে। চাষিদের কাছ থেকে আখ কিনে সেখানেই চলছে মাড়াইয়ের কাজ। শ্যামপুর চিনিকলের আওতাভূক্ত এলাকায়  অন্তত শতাধিক মাড়াই মেশিন স্থাপন করে চলছে গুড় তৈরির কাজ। আবার অনেকেই নতুন করে পাওয়ার ক্রাশার মেশিন স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বদরগঞ্জ উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের নাটারাম স্কুলপাড়ায় মাড়াইকল বসানো হয়েছে। সেখানের কৃষকের কাছ থেকে আখ কিনে গুড় মাড়াই করছেন আলতাব হোসেন (৫০)।

Caption

তিনি বলেন, 'সুগারমিল বন্ধ তাই কুশার(আখ) কাজে লাগাওছি। বাজরে আখ গুড়ের চাহিদা বেশি। প্রতি কেজি গুড় পাইকারী ৬৫-৭৫ টাকায় বিক্রি হওচে।'

এদিকে মিঠাপুকুর উপজেলার চিত্র আরো অন্যরকম। উপজেলার বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নের হাসিয়া গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে চলছে গুড় মাড়াই।

যমুনেশ্বরী নদীর তীরে মতিয়ার রহমান আখ থেকে গুড় মাড়াই করছেন। তিনি বলেন, 'মিল বন্ধ হইচে সেই জন্যে মেশিন কিনি আনছি। নিজের জমির কুশার দিয়ে গুড় তৈরি করছি।'

তিনি আরো জানান,  শুধু তিনি নন, তার আশপাশে অন্তত ৫০টি পুরাতন ও নতুন ক্রাশার মেশিন স্থাপন করে গুড় মাড়াই করা হচ্ছে । ৮০০ কেজি আখে ৫৬ কেজি গুড় হয়। দিনে কমপক্ষে ৬ মণ গুড় তৈরি করা সম্ভব।

লতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে প্রায় ৫ হাজার ২০০ একর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে

শ্যামপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, শ্যামপুর চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর আওতাভূক্ত এলাকায় উৎপাদিত আখ জয়পুরহাট চিনিকলে পাঠানো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই হিসাবে ২ জানুয়ারি মিলগেটে আখ নেওয়া শুরু হয়। চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে প্রায় ৫ হাজার ২০০ একর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে। শ্যামপুর চিনিকলের আওতায় প্রায় ৭ হাজার চাষি রয়েছে। আখ চাষে তাদের উদ্বদ্ধ করতে চলতি মৌসুমের জন্য ৩ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদী এ ফসল চাষ করতে সময় লাগে ১৪ থেকে ১৬ মাস। চাষিদের আখ চাষে আগ্রহ বাড়াতে বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে একর প্রতি ২৬ কুইন্টাল বীজ আখ সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও ১১০ কেজি টিএসপি, ৯৭ কেজি এমওপি সার দেওয়া হয়। মূলত জমি ছাড়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় চাষিদের।

চিনিকলের আওতায় ৬৫ ইউনিটে আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন। শ্যামপুর জোনের আওতায় অবৈধ পাওয়ার ক্রাশার রয়েছে ৭৪টি। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারে ভিন্ন। এবারে মিল বন্ধ থাকায় অন্তত দেড় শতাধিক পাওয়ারক্রাশার মেশিন স্থাপন করে চলছে মাড়াই।

হঠাৎ চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাষিরা বিপাকে পড়েছে

শ্যামপুর সুগারমিল অ্যামপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বুলু আমীন বলেন, ‘ হঠাৎ চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাষিরা বিপাকে পড়েছে। বন্ধ চিনিকল চালুর দাবিতে তারা আন্দোলন করছেন। চাষিরা প্রয়োজনে আখ পুড়ে ফেলবে তবু জয়পুরহাট চিনিকলে দিবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাছাড়া অনেক চাষি দীর্ঘ সুত্রিতার কারণে জয়পুরহাটে আখ দিতে অনিহা প্রকাশ করছেন। একারণে অনেকেই স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা মাড়াইকলে আখ বিক্রি করে দিচ্ছে।’

শ্যামপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দীলিপ কুমার সরকার বলেন, ‘শ্যামপুর জোনের উৎপাদিত সমুদয় আখ সংগ্রহ করে জয়পুরহাট চিনিকলে পাঠানো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক চাষি মনে করছেন আর আখ নেয়া হবে না। এ জন্য অনেকে আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি করছে।  দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।'

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের নির্দেশে উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া চিনিকলগুলো হচ্ছে কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, রংপুরের বদরগঞ্জের শ্যামপুর, রংপুর (মহিমাগঞ্জ) ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকল। এসব চিনিকলে ২ হাজার ৮৮৪ জন শ্রমিক কর্মচারী কর্মরত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর