দাঁড়াও পথিকবর- আমার নাম ‘কাইজেলিয়া’

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:32:03

রংপুর:‘কাইজেলিয়া’ একটি দুর্লভ প্রজাতির ঔষধি গাছ। বাংলাদেশে এই গাছের সংখ্যা রয়েছে মাত্র কয়েকটি। এরমধ্যে প্রায় শতবর্ষী দুটি কাইজেলিয়া গাছ রয়েছে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে। এর মধ্যে একটি গাছ রয়েছে কারমাইকেল কলেজের প্রধান ফটক থেকে ৫০০ গজ দক্ষিণে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিপরীত দিকে। গাছটির সঙ্গে সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে ‘দাঁড়াও পথিকবর, আমার নাম ‘কাইজেলিয়া’’। অপর গাছটি রয়েছে কলেজ মসজিদের সম্মুখে। এই দুটি কাইজেলিয়া গাছ ছাড়াও বর্তমানে এই ক্যাম্পাসে আরও তিনটি চারা রয়েছে।

এই কাইজেলিয়া গাছের আদি নিবাস আফ্রিকা মহাদেশের সেনেগালের দক্ষিণাঞ্চলে। আফ্রিকার বাইরে এই গাছটির অস্তিত্ব খুব বেশি দেখা যায় না।

পৃথিবীর বিরল প্রজাতির বিখ্যাত গাছগুলোর মধ্যে ‘কাইজেলিয়া’ একটি অন্যতম নাম। এটি ‘বিগনোনিয়াসিয়া’ গোত্রের গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘কাইজেলিয়া আফ্রিকানা’। কারমাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে ১৯১৬-১৯২০ সালে কোনো এক বৃক্ষপ্রেমী কাইজেলিয়ার দুটি চারা রোপণ করেছিল। বর্তমানে গাছ দুটির উচ্চতা প্রায় ২০-২৫ মিটার।

কাইজেলিয়ার ফুল হয় মেরুন অথবা কালচে লাল। ফুল থেকে গাছের থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা ফল লম্বাটে এবং গোলাকার হয়ে থাকে। একেকটি ফলের ওজন ৫ থেকে ১০ কেজি। সহজেই এই ফল ভেঙে ভেতরের বীজ বের করা যায় না। কাঁচা অবস্থায় ফলের রঙ সবুজ হয়ে থাকে, পাকলে বাদামি রঙ ধারণ করে।

কাইজেলিয়ার ফলকে প্রক্রিয়াজাত করে আলসার, সিফিলিস, সাপে কাটা রোগীর ওষুধ, বাত, ছত্রাক দমন, চর্মরোগ ও মেয়েদের প্রসাধনী এমনকি ক্যানসার রোগের চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা হয়।

কাইজেলিয়ার পরাগায়ন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল হওয়ায় এতদিন এর চারা উদ্ভাবন করা যায়নি। তবে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর সফল হয়েছেন অত্র কলেজের বাগান মালি বাটুল সিং। তিনি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাইজেলিয়ার ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে চারা উদ্ভাবনের চেষ্টা করে সফল হন। বর্তমানে বৃক্ষপ্রেমী বাটুল সিং দরিদ্রতার মধ্যে থেকেও অনেক কষ্ট করে কাইজেলিয়ার চারা উৎপাদন ও পরিচর্যা করে যাচ্ছেন।

বাটুল সিং জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে দেশীয় সনাতন পদ্ধতিতেই বিলুপ্ত কাইজেলিয়ার চারা উদ্ভাবনে চেষ্টা করে গেছেন। অবশেষে তিনি ২০১৫ সালের শেষের দিকে বেশ কয়েকটি চারা উৎপাদন করতে সক্ষম হন। হত-দরিদ্র বাটুল সিং নিজ হাতে দেশের প্রতিটি জেলায় কিংবা স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে অন্তত একটি করে হলেও চারা রোপণ করে কাইজেলিয়াকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চান।

এদিকে বিলুপ্ত এই কাইজেলিয়া বৃক্ষের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রতিশ্রুতিশীল সংগঠন কারমাইকেল কাইজেলিয়া শিক্ষা-সংস্কৃতি সংসদ (কাকাশিস)।

এই সংগঠনের সভাপতি রবিউল আলম রবি জানান, বাটুল সিংয়ের আগে বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারমাইকেল কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের একদল কৃষি বিজ্ঞানী টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে বিলুপ্ত কাইজেলিয়ার বেশ কয়েকটি চারা উদ্ভাবন করেছিলেন। কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে সেই চারাগুলো রোপণ করলেও সেগুলোকে আর বাঁচাতে পারেনি। সেই ব্যর্থতা ঘুচিয়েছেন বাগান মালি বাটুল সিং। বাটুল সিং সনাতন পদ্ধতিতে কাইজেলিয়ার চারা উদ্ভাবন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার উদ্ভাবিত চারাগুলো সংগ্রহ করে রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে রোপণ করা হচ্ছে।

কারমাইকেল কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রধান প্রফেসর নাজমা বেগম জানান, কাইজেলিয়া বিরল প্রজাতির একটি ঔষধি গাছ। এ গাছ দিয়ে বিভিন্ন জটিল রোগের ওষুধ তৈরি করা হয়। বর্তমানে কাইজেলিয়া বিলুপ্তির পথে থাকায় এর চারা উৎপাদনের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির চেষ্টা চলছে।

কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. শেখ আনোয়ার হোসেন জানান, প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটক ও বৃক্ষপ্রেমী দর্শনার্থীরা এই কাইজেলিয়া গাছটি দেখতে আসেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর