কয়েক বছর আগেও গোমতী নদীর এই চরজুড়ে বিভিন্ন সবজির চাষ হতো। পুরো চরজুড়ে থাকতো সবুজের হাসি। কিন্তু এখন পুরো চরটি ক্ষতবিক্ষত ভেকু ও কোদালের আঘাতে। ওরা আগে পুরো নদীটাই খেয়েছে। এরপরও ওদের পেট ভরেনি। এখন তাই গিলে খাচ্ছে গোমতীর চর। কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লা সদর উপজেলার গোমতী নদীর সামারচর এলাকায় জনি মিয়া।
সরেজমিনে নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লাগামহীনভাবে লোপাট হচ্ছে গোমতী নদীর বালু আর নদীর চরের কৃষি জমির মাটি। পুরো এলাকাটি দেখলে মনে হবে, যেনো বালু উত্তোলন আর মাটি কাটার প্রতিযোগীতা চলছে। প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই প্রভাবশালীরা নদীর বালু আর চরের মাটি গিলে খাচ্ছেন। বালু-মাটি খেকোদের আগে ‘খাদ্য’ ছিলো শুধুই নদীর বালু। কিন্তু নদী থেকে পর্যাপ্ত বালু উত্তোলন করতে না পারায় নিজেদের ব্যবসার জন্য নদীর চর ও নদী সংলগ্ন কৃষি জমিতে ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলছে তারা। আবার কোথাও কোথাও ভেকু ও কোদাল দিয়ে লোপাট হচ্ছে চরের কৃষি জমির মাটি। এতে গোমতী নদীর চর এলাকায় প্রতিদিনই কমছে কৃষি জমির পরিমাণ। অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে গোমতী নদীর দুই পাশের প্রতিরক্ষা বাঁধও দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্ষার সময় নদীতে জোয়ার আসলেই বড় ধরণের দুর্ঘটনার আশংকা করছে স্থানীয়রা।
এদিকে, বালু ও মাটি খেকোরা প্রশাসনকেও পাত্তা দিচ্ছে না। প্রায় দুই মাস ধরে নদীর বিভিন্ন অংশে জেলা প্রশাসনের কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও একদিনের জন্য থামেনি অবৈধ বালু উত্তোলন বা চরের মাটি কাটা। সর্বশেষ নদী ও নদীর চর রায় গত ১১ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে অভিযানে নামে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যরাও। কিন্তু এরপরও থামছে না চরের মাটি কাটা। আর কৃষকরা এসবের প্রতিবাদ করলেই বালু-মাটি খেকোরা তাদের উপর শুরু করে নির্যাতন। এজন্য এখন ভয়ে কোনো মানুষই মুখ খুলতে চায় না।
জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গোমতী নদীর সদর উপজেলার অংশে সরকারিভাবে বৈধ ৬টি বালুমহাল রয়েছে। এর ৫টি এবার ইজারা পেয়েছেন মাহাবুবুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। আরেকটি পেয়েছেন আরফানুল হক রিফাত। তবে এ উপজেলার পুরো নদী এলাকায় গেলে দেখা যায়, অন্তত ৪০টি স্থান থেকে অবাধে চলছে বালু ও চরের মাটি কাটার প্রতিযোগীতা।
সদর উপজেলা অংশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, অর্ধশতাধিক ড্রেজার ও ট্রলার দিয়ে চলছে বালু উত্তোলন। এসব বালু উত্তোলনের পর স্তুপ করে রাখা হয়। পরে এগুলো ট্রাকযোগ জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু মাত্র সদর উপজেলার অংশেই নয়। জেলার বুড়িচং, দেবিদ্বারসহ যেসব উপজেলার উপর দিয়ে গোমতী নদী বয়ে গেছে, সেখানেই চলছে একই কাজ। এতে করে দিন দিন যেনো অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে গোমতী। আর বালু-মাটি খেকোরা হয়ে পড়ছে অপ্রতিরোধ্য এবং নিয়ন্ত্রণহীন।
কুমিল্লার সদর উপজেলার গোমতী নদীর সংরাইশ, টিক্কারচর, অরণ্যপুর, ঝাকুনিপাড়া, শালধর পাঁচথুবী, জালুয়াপাড়া, বানাশুয়া, গোলাবাড়িসহ বিভিন্ন এলকা ঘুরে দেখা যায়, নদী আর চরে যেনো বালু-মাটি উত্তোলনের প্রতিযোগীতা চলছে। যে যার মতো করে নদীর বালু ও চরের মাটি লোপাট করছেন। এসব এলাকায় নদীর চর ও কৃষি জমির বেশিরভাগই বালু খেকোদের দখলে।অরণ্যপুর এলাকার কৃষক মনিরুল হক, সংরাইশ এলাকার আবদুল মজিদসহ বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, কৃষি জমিগুলো এখন শুধু নামেই আছে, বাস্তবে নেই। বালু আর মাটি খেকোরা সব শেষ করে দিয়েছে। তারা বলে এগুলো নাকি সরকার থেকে ইজারা নিয়েছে। এখন মানুষ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায় না। কারণ কথা বললেই শুরু হবে নির্যাতন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), কুমিল্লার নির্বাহী প্রকোশলী মো.আবদুল লতিফ বলেন, গোমতী নদীর বিভিন্ন অংশের বালুমহাল জেলা প্রশাসন ইজারা দিয়ে থাকে। এখন কোন শর্তে এসব ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেটা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবেন।
তবে জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো.আবু সাঈদ বলেন, জেলা প্রশাসন মাত্র ৬টি স্থানে সরকারিভাবে বালুমহাল ইজারা দিয়েছে, কোনো মাটিমহাল ইজারা দেয়নি। আর বৈধ বালুমহালের ইজারাদাররা শুধুমাত্র নদীর প্রভাবমান মধ্যখান থেকে বালু উত্তোলন করতে পারবেন। চরের মাটিতো দূরের কথা, নদীর পাড় সংলগ্ন স্থান থেকেও বালু তোলা অবৈধ।
তিনি আরও বলেন, এখন বিভিন্ন স্থানে নদীর সঙ্গে চরের জমিগুলোও শেষ করে ফেলতে চাইছে বালু-মাটি খেকোরা। তবে এসব বালু আর মাটিদস্যুরা যতোই প্রভাবশালী হোক না কেনো, আমরা তাদের ছাড় দেবো না। আমরা নদী ও চরের কৃষি জমি রক্ষায় গত কয়েক মাস ধরে একের পর এক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা অভিযানকালে যেখানে অবৈধভাবে মাটি-বালু উত্তোলন দেখছি, সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। মাটি-বালুদস্যুদের বিরুদ্ধে আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।