সকাল ৮ টার মধ্যে সংসারের কাজ শেষ করে দলবেঁধে আসেন কারখানায়। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে বিকেল ৫ টায় ছুটি। বাড়িতে গিয়ে আবার লেগে পড়তে হয় সংসারের কাজে। মাসের শেষে হাতে আসা বেতন তাদের আত্মনির্ভশীলতার হাসি ফোঁটায়। সমাজকে দেখিয়ে দিচ্ছে তারা আজ পিছিয়ে নেই। বলছি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় নারীদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি সংগঠনের তৈরি কারখানার নারী শ্রমিকদের কথা। সমাজের সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে তারা এখন আত্মনির্ভশীল হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে অন্যান্য নারীদেরও।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা শহরের উলিপুর চিলমারী সড়কের পাশে রামদাস ধনিরাম এলাকায় গড়ে ওঠা এই সংগঠনটির নাম ‘নারী অ্যাসোসিয়েট ফর রিভাইভাল এন্ড ইনিসিয়েটিভ’, (সংক্ষেপ NARRI)। প্রায় ১৫ বছর ধরে চলমান সংগঠনটি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এবং প্রশিক্ষণের পর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়ে নারীদের আত্মসাবলম্বী করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সংগঠনটির উদ্যোগে তাদের অফিসের পাশেই একটি তাঁতের কারখানা স্থাপন করা হয়েছে যেখানে প্রতিদিন কাজ করছেন শ’খানেক নারী। এছাড়াও সেখানে তাঁতের কাজ ছাড়াও বুনন শিল্পী হিসেবে কর্মসংস্থান হয়েছে কিছু নারীর। তাঁত যন্ত্র দিয়ে পাপস বুনন এবং পাটের আঁশ দিয়ে হাতের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র সেখানে প্রস্তত করা হয়।
কারখানায় প্রায় ১১ বছর ধরে তাঁতের কাজ করেন উলিপুরের ধামশ্রেণী এলাকার বাসীন্দা জোবেদা বেওয়া (৫৫)। আগে কাজ করতেন অন্যের বাড়িতে। প্রতিদিন কাজ না জোটায় বয়স হওয়া কৃষক স্বামীর একার পক্ষে সংসারের হাল টানা কষ্টকর হয়ে পড়ে। যুক্ত হন নারী সংগঠনটির সাথে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
জানালেন, কারখানা শুরু থেকেই তিনি আছেন। শুরুর দিকে উপার্জন কম হলেও এখন মোটামুটি ভালো যা তার সংসারকে স্বচ্ছলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রায় ৮ বছর থেকে তাঁতে পাপস বুনছেন কাশির খামার এলাকার বাসিন্দা কল্পনা বেগম(৩৫)। ট্রাক্টরের ড্রাইভার স্বামীর উপার্জনের টাকায় কোনমতে চলতো সংসার। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর একজনের উপার্জনে ছেলের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ সামলানো কঠিন হয়ে পরে। তাই বাড়িতে বসে না থেকে সংগঠনটিতে যোগ দেন কল্পনা বেগম। প্রশিক্ষণ শেষে শুরু করেন তাঁতে পাপস বোনা। তিনি জানালেন, একটি বড় সাইজের পাপস বুননে পান ২৮ টাকা ৫০ পয়সা করে। সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৯ ঘণ্টার পরিশ্রমে ৫ পিস থেকে ৮ পিস তৈরি করা সম্ভব। পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক কম বলেও অভিযোগ তার।
এছাড়াও পাটের আঁশ দিয়ে বুননের কাজ করছেন রামদাস ধনিরাম এলাকার বাসিন্দা শাহীনা বেগম (৩০)। ৫ বছর আগে কাজে যোগ দেয়ার সময় প্রোডাকশনের কাজ করলেও এখন অন্যদের কাজ শেখানোর পাশাপাশি কাজ দেখাশোনার দ্বায়িত্বও পেয়েছেন তিনি।
জানালেন, পাটের আঁশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, ঝুড়ি, হাতে তৈরি পাপস, মাদুর, সিকি, শো-পিস, টেবিলের কভার, মেঝের কভার, এসব জিনিস তৈরিতে ব্যবহৃত বেণী, সুতলি, শতরঞ্জিসহ নানান ধরনের সৌখিন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি হচ্ছে। কারখানার পাশাপাশি প্রায় দু’শো নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে বসে এগুলো তৈরি করছে বলেও জানান তিনি।
প্রায় ১১ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে আছেন ফরিদা ইয়াসমীন। সমাজে নারীদের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারীদের সংগঠনের আওতায় এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমূখী করে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সাবলম্বী করাই আমাদের মূল উদ্দ্যেশ্য। যারা যে ধরণের প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী তাদের সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সমাজে পিছিয়ে পড়া নারী যেমন, বিধবা, তালাক প্রাপ্তসহ বিভিন্ন অসহায় নারীদের আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। প্রায় ৬০০ সদস্যের এই নারী সংগঠনটি উলিপুর উপজেলা ছাড়াও কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট, চিলমারী উপজেলাতেও তাদের কর্মকাণ্ড প্রসারিত করেছে বলেও জানান তিনি।
এছাড়াও নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের সু্যোগ দিচ্ছে সংগঠনটি। উৎপাদিত এসব পণ্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি ছাড়াও বিদেশে রপ্তানি হয় উল্লেখ করে তিনি জানান, আমরা গ্রাহকের অর্ডার অনুসারে পণ্য প্রস্তুত করে থাকি। বেশিরভাগ পণ্য বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় দাম ভালো পাচ্ছি। বছরে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ লাখ টাকার ব্যবসা হচ্ছে। এতে আরও নারীদের যুক্ত করার পরিকল্পনাও উল্লেখ করেন তিনি।
বন্যা, নদীভাঙন, দারিদ্রতাসহ বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে আছে দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম। কিন্তু নিজেদের উন্নয়নে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা আরো এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন ফরিদা ইয়াসমীন।