ঋতু পরিবর্তনের সাথে নদ নদীরও গতিপথ বদলে যায়। যমুনা আর আগের মতো নেই। নদী দেখে মনে হয় না, এইখানে একদিন প্রবল স্রোতস্বিনী উত্তাল নদী ছিল। হারিয়ে যাচ্ছে নদী। এই নদীর পাড় আর নদীর চরে বাস করে এক কোটিরও বেশি মানুষ। এই এক কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত নদীর সাথে লড়াই করছে। লড়াই করছেন নদীর নিষ্ঠুর ভাঙনের সাথে। লড়াই করছেন অভাবের সাথে।
যমুনা চরসহ নদী পাড়ে বসত করা এসব মানুষ নদীর গতি প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। অভাব অনটন, ক্ষুধার যন্ত্রণা থাকলেও চরের মানুষ চর ছাড়তে নারাজ।
নদীর টানেই চরের মানুষ আশায় বুক বেঁধে পড়ে থাকে ভাঙা ও জীর্ণশীর্ণ ঘরে। বুক ভরা আশা, যে নদী দিনের পর দিন তাদের সর্বস্ব গ্রাস করেছে। সে নদীই একদিন ফিরিয়ে দেবে বাপ দাদার জমি জিরাত। বুক ভরা আশা, যদি হারিয়ে যাওয়া জোত জমি আবার জেগে ওঠে। এই আশা নিয়ে মৌসুমে মৌসুমে নদী আর প্রকৃতির সাথে লড়াই করছে চরের মানুষ। শত দুঃখ যন্ত্রণা নিয়ে অভাব-অনটন নিয়ে চরের মাটিকেই আঁকড়ে ধরে আছেন। তাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা, ভাঙা গড়াই নদীর খেলা।
নদী পাড়ের চরবাসী মনে করে, জোত জমি গেছে, গেছে ঘরবাড়ী ভিটে মাটি তাতে দুঃখ নেই। রাক্ষুসী নদী সব কেড়ে নিয়েছে। নদীর সাথে তারা যুদ্ধ করছে। নদীতেই তারা মরণ চায়। তাদের প্রত্যাশা তবুও নদী বেঁচে থাক। আগের মতো উত্তাল হয়ে উঠুক। বর্ষাকালে উত্তাল নদীর স্রোতধারার সাথে নদীবক্ষে বয়ে আনবে উর্বর পলি। শুস্ক মৌসুমে জেগে ওঠা সেই নরম পলিতে ফসল ফলাবে।
যমুনা সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে ৩৬টি চরে প্রায় দেড় লাখেরও বেশি মানুষের বাস। ঋতু বদলের সাথে নদীর রূপও বদলে যায়। সেই সাথে বদলে য়ায় চরের মানুষের পেশা। তারা কখনও কৃষক, কখনও জেলে, কখনও নৌকার মাঝি, কখনও ঘাটের কুলি। বর্ষাকালে উত্তাল নদীতে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে শুধু মাছ ধরে। আবার একদিন ছিল যেদিন ঘাটের কুলি মজুরের কাজ করে জীবন কাটিয়েছে। বিশাল যমুনা নদী এক সময় স্রোতধারা হারিয়ে যায়। চরে এসে মানুষ বসতি গড়ে তোলে। জেগে ওঠা এসব চরের বিভিন্ন নামকরণ করা হয়।
চরের নাম বান কি মুন, যমুনাবাজার, বউবাজার, খোতারচর ইত্যাদি। কাজিপুর উপজেলার প্রায় সবটাই চর হিসাবে গণ্য। এসব দুর্গম চরের মানুষ ঋতু পরিবর্তনের সাথে পেশা পরিবর্তন করে জীবিকা নির্বাহ করে। নদী যখন প্রবল, পানির গতি ছিল তখনই নদীর পাড়ে একদিন গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় ৫টি নদী বন্দর। কালের বিবর্তনে নদীর গতিপথ হারিয়ে যায়ার সাথে সাথে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা বন্দরও হারিয়ে গেছে। এ সব নদী বন্দরে একদিন ছিল শত শত কুলি মজুরের হাকডাক। কর্মমুখর এ সব নদী বন্দ এখন প্রবীণদের নিকট স্বপ্নের মতে মনে হয়। কত জাহাজ ও বিশাল পালতোলা মহাজনি নৌকা বন্দনে নোঙর করেছে। মালামাল ওঠানামা করেছে। বিখ্যাত সেই নদী বন্দরের মধ্যে কাজিপুর, নাটুয়ারপাড়া নদী বন্দরের এখন আর অস্তিত্ব নেই। নদীর অপ্রতিরোধ ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এসব নদী বন্দরে এখন আর জাহাজ ভেড়ে না। ভেড়ে না মহাজনি নৌকাও। পাল তোলা নৌকার জায়গা স্থান করে নিয়েছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা।
চরের প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ কাজ পেলে পেট ভরে খেতে পায়। কাজ না থাকলে খাবার জোটে না। বর্ষাকালে নৌকা চালিয়ে আর নদীতে মাছ ধরে জীবন চালায়। শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা নদীর বালির চরে মরিচ, ধান, পাট, চিনা, কাউন, বাদাম, তিল, তিশি চাষ করে। চরের মানুষ জেগে ওঠা চরের জমির অধিকার পায় না। চরবাসী দস্যুরা তাদের লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে জেগে ওঠা চর দখলে নেয়। চরের মানুষ সে জমিতে বর্গা চাষ করে। লাঠিয়াল বাহিনী তাদের চাষ করা জমির সব ফসল কেটে নিয়ে য়ায়।
সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সুলতানা হক ও মনসুর নগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রাজমহর জানান, শুষ্ক মৌসুমে চর থেকে চরে যাতায়াতের মাধ্যম পায়ে হেঁটে, বাইসাইকেল এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে চরের বালুতে চলছে ঘোড়ার গাড়ি ও ভ্যান। চরের মানুষ মরিচ, সবজি, পাট, ধান চাষ করে। তাদের জরিপে আরো জানা যায়, এসব চরের সাথে উপজেলা সদরের কোনও ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। মনসুরনগর থেকে কাজিপুরে সদরে আসতে এক মাত্র সহায় ইঞ্জিন চালিত নৌকা। সকালে একবার মনসুরনগর থেকে ছেড়ে যায়। আবার বিকালে ফিরে আসে। যাতায়াতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। বর্ষা মৌসুমে সময় লাগে একটু কম। প্রতিদিনই এ শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলে। বান কি মুন চর, পীরগাছা, রঘুনাথপুর, চরগিরিশ, রূপসা, খাসরাজবাড়ী, চরছিন্না, নাটুয়ারপাড়া, সানবান্ধা চরের স্থায়ী বাসিন্দা ওমর আলী, আফজাল হোসেন, আব্দুল কাদের, কামরুল, হাসান, কামাল হোসেন, নুরুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন যমুনা নদীর ভাঙা-গড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বেঁচে আছে। নদীর ভাঙনে বসতবাড়ি জমি-জমা হারিয়েও চর ছাড়ে না।
তাদের একটিই কথা, নদীর টানেই তারা পড়ে থাকে চর থেকে চরে। নদী যেমন দুঃখ দেয়, কেড়ে নেয় ঘর-বাড়ি, জোতজমি। তেমনি নদীই তাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে তারা পেশা বদল করে। এক সময় জেলে। কোন সময় নৌকার মাঝি। আবার এক সময় কৃষক। সময়ে ঘাটের ঘাটে কুলি-মজুরের কাজ করে। চরবাসীর দাবি চরের জেগে ওঠা জমির সুষ্ঠু বন্টন বা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা অপরিহার্য। চরগ্রাসীদের কবল মুক্ত করা হলে চরের মানুষের দুঃখ থাকবে না। মৌসুমে একটা সময় আসে যখন হাতে কাজ থাকে না। সে সময় চরাঞ্চলে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করলে কোনও কষ্ট স্পর্শ করতে পারবে না।