করোনার মহাবিপর্যয় থেকে মুক্তি পেতে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে আসন্ন বাজেটের আকার কমপক্ষে ১৫ লাখ কোটি টাকা হওয়া উচিত বলে মনে করে গণমানুষের অর্থনীতিবিদ হিসেবে খ্যাত আবুল বারকাত।
রোববার (১১ এপ্রিল) দুপুরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের আমন্ত্রণে এক অনলাইন সভায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি হিসেবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জামালউদ্দিন আহমেদসহ সমিতির প্রতিনিধিদের নিয়ে উপস্থিত ছিলেন আবুল বারকাত। এসময় তিনি এমন একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
আবুল বারকাত বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির মহাবিপর্যয় থেকে মুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে উল্লেখিত পদ্ধতিগত ভিত্তি-ভাবনা প্রয়োগে আমরা মনে করি যে, আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের মোট আকার (পরিচালন ও উন্নয়ন মিলে) হওয়া উচিত কমপক্ষে ১৫ লাখ কোটি টাকা। আমাদের প্রস্তাব বৃহদাকার-সম্প্রসারণশীল বাজেট।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা এড়াতে ও করোনাভাইরাসের বিপর্যয় কাটাতে বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে বৈষম্যহীন ‘শোভন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ যা ছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। বাজেট প্রণয়নে দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের বিধানগুলোকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিতে হবে।
প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যের বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির কার্যনির্বাহক কমিটির পক্ষ হতে আসন্ন বাজেট প্রণয়নে নীতিগত বিষয়াদি সভায় উপস্থাপন করেন তিনি।
বারকাত তার বক্তব্যের শুরুতে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর বাজেট বৈষম্যহীন আলোকিত মানুষ সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে করবেন নাকি মুক্তবাজার আর করপোরেট-স্বার্থীয় সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রকদের বিশ্বায়নের হাতে ছেড়ে দেবেন এ সিদ্ধান্তটা নিতে হবে। অন্যথায় আমরা গতানুগতিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাব। জিডিপি বাড়লেও বাড়তে পারে; মাথপিছু আয় বাড়লেও বাড়তে পারে কিন্তু বৈষম্য-অসমতা নিরসন হবে না, হবে না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা অভীষ্ট বাস্তবায়ন।
দুই বৈশ্বিক মহাবিপর্যয়- অর্থনৈতিক মহামন্দা ও কোভিড-১৯ উদ্ভূত মহামারিতে চার-মাত্রিক সমস্যা ও সেসব সমস্যা থেকে উত্তরণে কয়েক দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন তিনি।
প্রথম মাত্রা: সব দোষ কোভিড-১৯ ভাইরাসের এটা সত্য নয়। আসল কথাও নয়। শোভন অর্থনীতির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হলো রেন্টসিকার-পরজীবী-লুটেরা-জোম্বি করপোরেশন-স্ব জনতুষ্টিবাদী মুক্তবাজার পুঁজিবাদ।
দ্বিতীয় মাত্রা: দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা মহামারি সময়ের আগের তুলনায় কমপক্ষে দ্বিগুণ বেড়েছে। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের ব্যাপক হারে শহর থেকে গ্রামমুখী হওয়া। লকডাউনের কারণেই অফ-লাইন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা, সেবাখাতে অধোগতি হয়েছে, আর ফুলে-ফেঁপে উঠেছে অন-লাইন ব্যবসা-বাণিজ্য। এতে রেন্ট সিকার-দুর্বৃত্ত-লুটেরা-পরজীবীরা মুক্তবাজারে মুক্তবিহঙ্গ হয়ে তাদের আয়-সম্পদ-সম্পত্তি বিপুল বাড়িয়েছে। এসবের ফলে আয় বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য, স্বাস্থ্য বৈষম্য, শিক্ষা বৈষম্যসহ বৈষম্যের সব ধরনই বেড়েছে।
তৃতীয় মাত্রা: দেশে মোট শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৮২ লাখ ৬ হাজার, যাদের ৮৫% অর্থাৎ ৫ কোটি শ্রমজীবী মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। কোভিড-উদ্ভূত লকডাউনে এসব মানুষের অধিকাংশই হয় কর্মহীন অথবা স্বল্প মজুরিতে স্বল্প সময়ের জন্য সাময়িককালীন কর্মজীবী। কারণ কর্মবাজার সংকুচিত হয়েছে, সামনে আরও হবে। পরিবার-পরিজনসহ এসব মানুষের পক্ষে জীবন পরিচালন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এদের হাতে টাকা-পয়সা নেই; অনেকেই যা কিছু ছিল তাও বেচতে বাধ্য হয়েছেন।
চতুর্থ মাত্রা: অর্থনীতিবিদদের প্রায় সবাই বলে থাকেন জিনিসপত্তরের দাম বাড়া বা মূল্যস্ফীতি হলো গরিবের শত্রু। একথা মিথ্যা নয়। তবে যে কথা তারা বলেন না তা হলো মূল্যহ্রাস বা মূল্য সংকোচন হলো গরিবের মহাশত্রু। ১৯২৯-৩৩-এর মহামন্দাকালে মূল্যস্ফীতি ঘটেনি, ঘটেছিল মূল্যহ্রাস বা মূল্যসংকোচন; আর ওই মহামন্দার পরপরই মূল্যহ্রাসের সুযোগে নির্বাচনের মাধ্যমেই ফ্যাসিস্ট হিটলার জার্মানিতে ক্ষমতায় বসে পড়েন।
এ সমস্যাগুলো থেকে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বাঁচাতে আবুল বারকাত বাজেট প্রণেতাদের যে পরামর্শ দেন সেগুলো হলো, ধনী-বিত্তশালীদের ওপর সম্পদ কর আরোপ করা, সুপার-ডুপার ধনীদের ওপর কর হার বাড়ানো, শেয়ার বাজার ও বন্ড বাজারে বড় বিনিয়োগের ওপর সম্পদ কর আরোপ করা, অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর আরোপ করা, কালো টাকা উদ্ধার করা, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করা ও সরকারিভাবে শোভন মজুরির ব্যাপক কর্মসংস্থান-সুযোগ সৃষ্টি করা।