বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সংকট, পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রকল্প

, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2023-09-01 12:00:48

শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় সরকারের পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। ‘অপারেশনালাইজিং ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক এই প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে ওয়ারপো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চে পরিকল্পনা কমিশন ১৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার এই প্রকল্পটি অনুমোদন করে। এর মধ্যে সরকার ১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা দেবে। আর বাকি ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা দেবে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশন (এসডিসি)। প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে আছে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)। এটি বাস্তবায়নে সহায়তা করছে ডাসকোহ।

প্রকল্পের কাজ শুরু করতে গত ১৯ মার্চ ওয়ারপো রাজশাহীতে তাঁদের একটি অফিস চালু করেছে। এছাড়া রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সরদহ ইউনিয়নে একটি পানি মডেলিং প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় তিন জেলার প্রতিটি মৌজায় পানির কি অবস্থা তা পরিমাপ করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

খালের তলদেশ শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে

গবেষকেরা জানিয়েছেন, কৃষি কাজের জন্য বরেন্দ্র এলাকায় অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলার কারণে পানির স্তর প্রতিবছর গড়ে দুই থেকে তিন ফুট নেমে যাচ্ছে। এর ফলে এ অঞ্চলে পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। এর মধ্যে রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর, নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলা সবচেয়ে উঁচু এলাকা। আর বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচেয়ে উঁচু গোমস্তাপুরের পার্বতীপুর ইউনিয়ন। এরপরই আছে তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরসভা এবং বাঁধাইড় ইউনিয়ন এলাকা। এসব এলাকায় এখন পানির জন্য হাহাকার চলছে।

তানোরের আকশা গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কের নিচ দিয়ে আড়াআড়িভাবে চলে গেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) খনন করা একটি খাল। কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে এমন অনেক খাল খনন করেছে বিএমডিএ। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল, আকশা গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া খালটি পুরোপুরি পানিশূন্য। খালের পাশেই আছে বিএমডিএ’র একটি গভীর নলকূপ। খালে পানি না থাকার কারণে এখনও গভীর নলকূপে তোলা পানি দিয়ে কৃষিকাজ করছেন চাষিরা।

১৯৮৫ সাল থেকে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে এসব গভীর নলকূপ বসাতে শুরু করে। সমগ্র বরেন্দ্র এলাকায় এখন ১৫ হাজার ১০০টি গভীর নলকূপ আছে। ২০১২ সালের দিকে সরকার কৃষিকাজের জন্য আর ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর থেকে বিএমডিএ নতুন করে আর নলকূপ বসাচ্ছে না। ভূ-উপরস্থ পানির আধার সৃষ্টি করতে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক খাল ও খাড়ি সংস্কার এবং খনন করলেও তা কাজে আসছে না। ফলে কৃষকদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাই ব্যক্তিমালিকানায়ও গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে।

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, বরেন্দ্র অঞ্চলে এক কেজি ধান উৎপাদনে তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এক বিঘা বোরো ধান চাষে প্রয়োজন হচ্ছে ২৪ লাখ লিটার পানি। বার্ষিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭১০ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর প্রায় ৭০ শতাংশই ব্যক্তিমালিকানায় বসানো গভীর নলকূপ দিয়ে তোলা হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে বছরে যে পরিমাণ পানি তোলা হয় তা দিয়ে এক বিঘা আয়তনের ১৮ লাখ পুকুর দুই মিটার গভীর করে পানি দিয়ে ভরা যাবে। গভীর নলকূপ দিয়ে এত বেশি পরিমাণ পানি তোলার কারণে গোদাগাড়ী, তানোরসহ বরেন্দ্রের অন্যান্য এলাকায় সাধারণ টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে। পানির জন্য এখন সবাইকে সাবমার্সিবল পাম্পে ভরসা রাখতে হচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (আইবিএস) গবেষক রাজ্জাকুল ইসলাম জানান, ১৯৮০ সালেও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর মাটির মাত্র ৩৯ ফুট নিচে ছিল। ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাতলা একটা পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে। তিনি জানান, দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এ বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় পুনর্ভরণের হার দেশে ২৫ শতাংশ হলেও এ অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ।

চৈত্রের কাঠ ফাটা রোদ্দুরে মাঠ ফেটে চৌচির

বেসরকারি সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন সুইজারল্যান্ডের অর্থায়নে বরেন্দ্র অঞ্চলে ‘সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা (আইডব্লিউআরএম)’ নামে একটি প্রল্পের কাজ করছে। প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর আলম খান জানিয়েছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের কোথাও কোথাও পানির স্তর ১৫০ ফুটেরও নিচে নেমে গেছে। তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরভবনের পাশেই ২০১৬ সালে তারা একটা পানি মাপার কূপ তৈরি করেছিলেন। কূপের ভেতর একটা ডিভাইস পাঠিয়ে গভীরতা পরিমাপ করা হতো। ডিভাইসটি নিচে গিয়ে পানি স্পর্শ করলেই ওপরে ডিভাইসের বেল বাজত। ১৫ দিন পর পরই তাঁরা পানির গভীরতা মাপতেন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মাটির ১৫০ ফুট নিচে গিয়েও আর ডিভাইসের বেল বাজছে না। অর্থাৎ ডিভাইসটি এখন আর পানি পাচ্ছে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভূ-তত্ব ত্ত খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল ২০১৪ সাল থেকে বরেন্দ্রে অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে যেভাবে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে তা খুবই চিন্তার বিষয়। পানি নিচে নেমে গেলে নিচে বালু, পাথর ফাঁকা হয়ে পড়বে। তখন সামান্য ভূমিকম্প হলেই দেবে যেতে পারে বিশাল এলাকা।

তিনি বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলকে বাঁচাতে হলে পানির কোন বিকল্প না। এ জন্য প্রথমেই ভূ-গর্ভস্থ পানি সেচ কাজে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুকুর-খাড়ি বেশি করে খনন করতে হবে। বাসা বাড়ির ছাদের পানি মাটির নিচে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এক কথায় বৃষ্টির পানি বেশি বেশি রিচার্জ করতে হবে। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু প্রসঙ্গে ওয়ারপো’র মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, তাঁদের প্রকল্পের আওতায় ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানিসম্পদের মানচিত্র তৈরি করা হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পানির প্রাপ্যতা এবং পর্যাপ্ততা পরিমাপ করা হবে। ফলে পানি কতটুকু ব্যবহার করা যাবে তা জানা সম্ভব হবে। তাছাড়া তারা এ অঞ্চলে পানির চাহিদা নির্ধারণ করবেন। ভূগর্ভস্থ পানি কতটুকু তোলা যাবে সেটাও নির্ধারণ করা হবে। প্রয়োজনে যে কোনো এলাকাকে পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এভাবে ভূ-গর্ভস্থ ও ভূপরিস্থ পানিশাসন দেশে এটাই প্রথম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর