শুকিয়ে গেছে পদ্মার শাখা নদ বড়াল। এই নদের বুক চিরে চলে গেছে ছোট্ট একটি খাল। সেই খালের পানি দিয়ে বেশিরভাগ অংশজুড়ে চাষ হয়েছে বোরো ধানের। স্লুইস গেট দিয়ে পানির প্রবাহ কমিয়ে ফেলা এবং নাব্যতা কমে আসায় নদটির এখন করুণ দশা। দীর্ঘ দিন ধরেই ড্রেজিং করে এই নদে আবারও প্রাণ ফেরানোর দাবি জানাচ্ছেন পরিবেশবাদীরা। কিন্তু লাভ হয়নি।
পদ্মা থেকে বড়াল নদের উৎপত্তি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায়। এরপর নদটি রাজশাহীর বাঘা, নাটোরের বাগাতিপাড়া ও বড়াইগ্রাম; পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বাঘাবাড়ি হয়ে হুরাসাগরের বুকে মিশেছে। হুরাসাগর মিশেছে যমুনার সাথে। বড়ালের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৯ কিলোমিটার। এক সময় সারাবছর যোগাযোগের জন্য নৌপথটি ব্যবহার হতো। এখন সবই স্মৃতি। ভরা মৌসুমের দুই মাস নদে নৌযান চলতে পারে। তারপর আবার শুকিয়ে যায়। শুরু হয় ফসলের আবাদ। নদের বুকে এখন রয়েছে বোরো ধান।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, চারঘাট এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৮৫ সালে বড়ালের উৎপত্তিস্থলে একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এর ফলে বড়ালে পানি কমতে থাকে। সে সময় বড়ালের উৎসস্থল চারঘাটে একটি স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। পরে নদের ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে আটঘড়ি নামক স্থানে আরও একটি স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। এছাড়া ১২৫ কিলোমিটার ভাটিতে পাবনার চাটমোহরে আড়াআড়িভাবে তিনটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়। দহপাড়া এলাকাতেও আরও একটি স্লুইস গেট তৈরি করা হয়। স্লুইস গেটগুলো নষ্ট হয়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে বড়ালে পানিপ্রবাহ থেমে যায়। ধীরে ধীরে বড়াল মরতে থাকে। এখন ভরা মৌসুমে চারঘাট স্লুইস গেট হয়ে বড়াল নদে পানি ঢুকলেও অন্য এলাকায় গিয়ে আবার স্লুইস গেটে আটকে যায়। ফলে ঠিকমতো পানির প্রবাহ নিশ্চিত হয় না। কিছু দিনের মধ্যেই বড়ালের পানি শুকিয়ে যায়।
সম্প্রতি চারঘাট উপজেলা সদরে বড়ালের উৎপত্তিস্থলে গিয়ে দেখা যায়, স্লুইস গেটের কপাট খোলা। কিন্তু পদ্মার যে অংশ দিয়ে বড়ালে পানি ঢুকবে সেখানেই পানি নেই। ফলে বড়ালে পদ্মা থেকে এখন কোন পানি আসছে না। চারঘাট এলাকায় বড়ালের বুকজুড়ে ধান চাষের চিত্র দেখা যায়। ধানে সার দিচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সাবিয়ার রহমান। তিনি বললেন, যার বাড়ি বা জমির সামনে নদের যে অংশ পড়েছে তিনি সেখানে ধান চাষ করেন। বছরের পর বছর এটাই হয়ে আসছে।
বাঘার রুস্তমপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বড়ালের বুক চিরে ছোট্ট একটা খাল চলে গেছে। খালটির দুইপাশে নদীর বেশিরভাগ অংশে চাষ হয়েছে বোরো ধান। স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, বছরের বেশিরভাগ সময়ই নদে চাষবাস হয়। শুধু বর্ষার সময় মাস দুয়েক পানি থাকে। তিনি বলেন, সারাবছর নদে চাষাবাদ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পানি থাকলেই ভালো হতো। নদের পানি ব্যবহার করে পাড়ের দুইপাশের জমিগুলোতে আরও বেশি ভালো আবাদ করা যেত।
রুস্তমপুর এলাকার বৃদ্ধ জুলমত আলী এখন আমবাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। আগে বড়ালেই মাছ ধরে চলত তাঁর জীবিকা। জুলমত বলেন, বড়ালে মাছ ধরে সংসার চালিয়েছি। জমি কিনেছি। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখন কিছুই হবে না। এখন মানুষের বাগানে বাগানে কাজ করি। জুলমত বলেন, এই নদে স্রোত দেখেছি। চোখের সামনে একে মরতেও দেখছি।
বড়ালকে বাঁচাতে রাজশাহীর চারঘাট, পাবনার চাটমোহরসহ বিভিন্ন এলাকায় নদ রক্ষা কমিটি হয়েছে। কমিটির নেতারা স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলনও করেন। শেষে বড়ালে পদ্মার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে এবং নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে নাটোরের নারদ ও মুসা খাঁ নদের আংশিক এবং চারঘাটের বড়ালের প্রবেশমুখ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৩ কোটি ৩ লাখ টাকার প্রকল্পে নারদ, মুসা খাঁ ও বড়ালের প্রায় ১৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার খনন করা হয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চারঘাটে বড়ালের ইনটেক চ্যানেল খনন কাজ শেষ হয়। কিন্তু বর্ষায় বড়ালে পানি যায়নি। নদ থেকে খনন করা বালু আবার নদেই চলে গেছে।
চারঘাট বড়াল নদ রক্ষা কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বাদশা জানান, আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে বড়ালের প্রবেশমুখ খনন করা হয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আবার আগের মতো। নদের বালু নদেই নেমে গেছে। ওই কাজে দুর্নীতি হয়েছে। চরম গাফিলতি হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এই চিহ্ন মুছে যেতে চলেছে। এই বড়ালেই চলত হাজারও মানুষের জীবিকা। আমরা চাই বড়ালে আবারও প্রাণ ফিরুক। এ জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। বাদশা বলেন, প্রায় ৮৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বড়ালে যদি সারাবছর পানি থাকে তাহলে কয়েকটি উপজেলার চিত্র বদলে যাবে। নৌপথে কমখরচে যোগাযোগ সহজ হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। নদের দুইপাশ আবারও সবুজে ভরে যাবে। ফসলের আবাদ বাড়বে। তাই এই নদ রক্ষায় আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম শেখ বলেন, বড়াল নদ রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে নাটোর পাউবো। তাঁরা আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রস্তুত করেছে। সেটি ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে জমাও দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি যদি অনুমোদন পায় তাহলে বড়াল আবারও খনন করা যাবে। স্লুইস গেটগুলো সংস্কার করা হবে। তখন স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ নিশ্চিত হবে। এতে বড়ালে প্রাণ ফিরবে।