করোনা ভাইরাস মহামারীর প্রথম ধাক্কাটি শেষ না হতেই দ্বিতীয় ঢেউ দেশে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। তাই করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার দেশে লকডাউন দিয়েছে। এর ফলে আয় কমে যাওয়ায় বিপদে পড়েছে দেশের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক খাদ্যসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। যা স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্য অধিকার ও খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। সেমিনারটি ছিলো দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ও খাদ্যগ্রহণে প্রভাব শীর্ষক জরিপের ফলাফল নিয়ে।
সেমিনারে বক্তারা জানান, করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না, যদি না দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। এজন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এখনই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন, বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি। সম্মানীয় আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন চেয়ারম্যান ড. সায়মা হক বিদিশা, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আবুল কালাম আজাদ, কর্মসূচি পরিচালক, দক্ষিণ এশিয়া, ইকো কোঅপারেশন। এটি সঞ্চালনা করেন মহসিন আলী, সাধারণ সম্পাদক, খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ ও নির্বাহী পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন। জরিপের সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন ড. নাজনীন আহমেদ, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বিআইডিএস।
এছাড়া আয়োজকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন, এস এম নাজের হোসেন, সহ-সভাপতি, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বিভাগীয় প্রতিনিধি ও সভাপতি, চট্রগ্রাম জেলা কমিটি। মোসাম্মাৎ সুলতানা রাজিয়া খাতুন, সভাপতি, দিনাজপুর জেলা কমিটি, খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ ও প্রধান নির্বাহী, এমবিএসকে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি উপস্থাপিত সুপারিশগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, এখন একটি অস্বাভাবিক সময় আমরা অতিক্রম করছি। মানুষের আয় কমে গেছে, পাশাপাশি খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি দরিদ্র মানুষকে বিপদগ্রস্ত করেছে। আমরা টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে খাদ্য সামগ্রী বিক্রির একটি উদ্যোগ নিয়েছি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারেও তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে চলেছে, তার একটা প্রভাব দেশের বাজারেও পড়ছে। দাম কমানোর জন্য খাদ্য, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যার যার জায়গা থেকে কাজ করছে। আমরা মনিটরিং করছি। কিন্তু, পর্যাপ্ত লোকবল আমাদের নেই। মাত্র ২৮টি টিম কাজটি করছে।
তিনি আরও বলেন, এ রমজান মাসে টিসিবির মাধ্যমে বিক্রির জন্য ৩৫ হাজার টন সয়াবিন তেল বরাদ্দ করা হয়েছিল। তবে এ মুহূর্তে মানুষের কাজ না থাকাটা আসলেই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সরকার এজন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। গত বছরে হঠাৎ বন্যার কারণে চালের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছিল। তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে না কমলে আমাদের পক্ষে বেশিকিছু করার থাকে না। তবে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে বিক্রির পরিমাণ আমরা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি।
ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, যেসব মানুষ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে রয়েছে, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে তারাও খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পতিত হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম দেখা যায় না। সেজন্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কমিশন গঠন করা দরকার। এ কমিশন গবেষণার আলোকে সুপারিশ তুলে ধরবে এবং বাজার মনিটরিংয়ে ভূমিকা রাখবে। খাদ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা দরকার। পুষ্টি নিশ্চিত করতে বৈচিত্রপূর্ণ খাদ্যগ্রহণে মানুষকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি ন্যায্যমূল্যে যোগান নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শিশুদের পুষ্টির বিষয়টির উপর বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। দ্রব্যমূল্য সম্পর্কিত সঠিক তথ্যও জনগণকে জানাতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয়।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশ সরকার একটি কৃষিবান্ধব সরকার এবং কৃষকদের নানারকম সহযোগিতা করে থাকেন। কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও কৃষকরা সেখান থেকে লাভবান হয় না। লাভবান হয় মজুতদাররা। তাদের সিন্ডিকেটই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। লকডাউনের সময় আবারও খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি সে পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কৃষক যেন কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সেদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। বাজার মনিটরিংয়ের উপর জোর দিতে হবে।
মহসিন আলী জানান, খোলা বাজারে বিক্রি বৃদ্ধির পাশাপাশি দরিদ্র মানুষ যেন তাদের হাতের কাছে খাদ্যসামগ্রী পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
জরিপের ফলাফল উপস্থাপনকালে ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতি গত বছর থেকেই বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনই শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। ইতিমধ্যে সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে করোনার বিস্তার ঠেকানোর জন্য। এর ফলে নিম্নআয়ের মানুষ বিশেষত দিনমজুর, রিক্সাওয়ালা, রাস্তার ধারের হকাররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ ইতিমধ্যে যে তাৎক্ষণিক জরিপ চালিয়েছে তাতে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের এ মুহূর্তের যে পর্যবেক্ষণ তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ ব্যক্তির পরিবার তিনবেলা খাবার যোগাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। প্রায় ৬৫.৭১ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। ৩৭.১৪ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে খাদ্যসহ দৈনিন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছেন। স্বল্প আয়ের এসব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারি সহায়তা দরকার।
সেমিনারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য যেসব করণীয় তিনি তুলে ধরেন সেগুলো হলো- খাদ্য নিরাপত্তাকে সকল নাগরিকের অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করতে হবে, খোলাবাজারে চাল বিক্রি বৃদ্ধি করতে হবে, আগামী এক বছরের জন্য এলাকাভিত্তিক কয়েকটি স্থায়ী খোলা বাজারে বিক্রির জন্য দোকান তৈরি করা যেতে পারে, টিসিবির বিক্রির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, সমাজের ধনী ব্যক্তিদের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে দ্রব্যসামগ্রী কিনে মজুত করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে মুদি দোকানগুলোর মজুত ব্যবস্থা নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।