ময়মনসিংহের শতবর্ষী পুস্তিকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব

, জাতীয়

ড. রূপকুমার বর্মণ | 2023-08-28 06:22:50

সভ্যতার পথচলায়, সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক পরিক্রমায় এবং মনন ও সৃজনের ইতিহাসে লেখক ও পাঠকের পারস্পরিক সম্পর্ক এতটাই গভীর যে একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনের কথা চিন্তাই করা যায় না। প্রজন্মান্তরের পাঠকই স্থির করেন লেখার গুণগত মান।

গল্প, কবিতা, উপন্যাস, কাব্য, মহাকাব্য বা গবেষণামূলক প্রবন্ধের গ্রহণযোগ্যতা ও তাদের স্থায়িত্ব অনেকটাই নির্ভর করে প্রচার ও পাঠকের উপর। বিজ্ঞাপনের মাহাত্ম্য থাকলেও উপভোক্তা হিসাবে লেখকের গ্রহণযোগ্যতা পাঠকের মননশীলতার উর্দ্ধে উঠতে পারেনা। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে নোবেলজয়ী আমেরিকান সাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনারের (William Faulkner: ১৮৯৭-১৯৬২) কথা। তিনি একবার বলেছিলেন:

“Read, read and read. Read everything----trash, classics, good and bad, and see how they do it. Just like a carpenter who works as an apprentice and studies the master. Read! You will absorb it.”

হ্যাঁ, পাঠকেই সব পড়েন---- কাগজের ঠোঙ্গা থেকে ক্লাসিক। ভাল, মন্দ, ছোট, বড়, রসাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক, শ্লীল, অশ্লীল, ভাববাদী, স্থুলবাদী, বেদনাদায়ক বা হাস্যরসাত্মক----সবধরণের লেখারই অসংখ্য পাঠক আছেন। পাঠকের জন্যই ভাল সৃষ্টিগুলোর পাঠ যুগযুগ ধরে চলতে থাকে। পাঠকের অভাবেই অনেক লেখাই চলে যায় বিস্মৃতির গভীর সমুদ্রে। নিজের তাগিদে পাঠকই আবার সেগুলোকে ফিরিয়ে আনেন।

স্বাভাবতই কোন একজন সুলেখক বা চিন্তাবিদ তাঁর অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে তাঁর সমকালীন সমাজের ঘটনাবলী,  জীবন-দর্শন ও সংস্কৃতির যে ধারাকে তাঁর সুচিন্তিত মতামত দিয়ে পৃষ্ঠাবদ্ধ করে নেন, বহু বছর পর পাঠক যখন সেই মুদ্রিত পাতায় চোখ রাখেন পৃষ্ঠাবদ্ধ সেই ধারা পুনরায় বইতে শুরু করে। এই পুনর্পাঠ অবশ্য পাঠকের সমকালীন ভাবনা ও বিচারের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হয় (তা সে ধর্মগ্রন্থ, ক্লাসিক, আত্মজীবনী বা রম্যরচনা যাই হউক না কেন)। অর্থাৎ কোন গ্রন্থের শতবর্ষ পড়ে তার পুনর্পাঠ শতবর্ষ পুরানো পৃষ্ঠাবদ্ধ ধারাকে যেমন খুলে দেয় তেমনি নতুন পাঠকের সমকালীন ভাবনায় তাকে প্রানবন্ত করে তোলে।

এই বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য ১৯১৪ সালে (তৎকালীন অখণ্ড বাংলার) ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকার পুনর্পাঠের উপলদ্ধি তুলে ধরা যেতে পারে। ময়মনসিংহের সেন ব্রার্দাস প্রেসে মুদ্রিত এই পুস্তিকার নাম ‘দ্বিতীয়বর্ণ (ক্ষত্রিয়) বা ঝালমাল তত্ত্ব’। লেখক ময়মনসিংহের ছত্রপুরের শ্রীমহেন্দ্রনাথ মল্লবর্মণ। এর প্রকাশক ছিলেন ময়মনসিংহ জেলারই আচারগ্রামের (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ সংলগ্ন নান্দাইল উপজেলাধীন) দীননাথ মল্লবর্মণ।

‘ঝালমাল তত্ত্ব’ রচিত হয়েছিল পূর্ব ও মধ্যবাংলার মৎস্যজীবীদের সম্মানজনক সামাজিক পরিচিতি নির্মাণের জন্য। ইতিহাসের দিকে লক্ষ রাখলে দেখা যাবে যে, প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণ এশিয়ার ‘জাত-বর্ণ ব্যবস্থায়’ মৎস্যজীবীদের অন্তজঃ হিসাবে দেখা হতো। বিশ শতকের গোড়াতেও বাংলার মৎস্যজীবীরা জাত-ব্যবস্থার অভিশাপে জর্জরিত ছিলেন। তাঁরা বাঙালীদের প্রিয় খাদ্য মাছের যোগানদার হলেও উচ্চবর্ণীয়/উচ্চবর্গীয় মানুষেরা তাঁদের জাতিগত পেশাকে (মাছ ধরা/ বিক্রি করা) সম্মানের চোখে দেখতেন না।

মহেন্দ্রনাথ মল্লবর্মণ তাঁর স্বজাতিবর্গের (ব্রজনাথ ঝল্লবর্মণ, অনন্ত চন্দ্র ঝল্লবর্মণ, দীননাথ মল্লবর্মণ, হৃদয়নাথ হালদার, আনন্দ চন্দ্র মল্লবর্মণ এবং আরও অনেকের) উৎসাহে মৎস্যজীবীদের ক্ষত্রিয় পরিচিতি নির্মাণে প্রায়াসী হয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতি হল ‘ঝলমাল তত্ত্ব’।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ঊনিশ শতকের শেষ লগ্নে ও বিশ শতকের সূচনাপর্বে ঔপনিবেশিক বাংলার বেশ কয়েকটি নিম্নবর্ণীয় জাতি [যেমন পৌন্ড্র, রাজবংশী, নমঃশূদ্র, ভুঁইমালী, মালো, শুঁড়ি, বাগদি, বাউড়ি, ধোবা, গোপ, ইত্যাদি] সম্মানজনক জাতি পরিচিতি নির্মাণে জন্য সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিল। তৎকালীন বাংলার ক্ষত্রিয় আন্দোলনকারী বিভিন্ন জাতির মধ্যে ‘জাতি বিষয়ক’ গ্রন্থ প্রকাশের একটি সুনির্দিষ্ট ধারাও তৈরি হয়েছিল। পৌন্ড্র জাতির শ্রীমন্ত নস্করের (১৮৬৩-১৯০৭) ‘জাতিচন্দ্রিকা’ (১৮৮৭) প্রকাশের মধ্য দিয়ে এর সূচনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে বেণীমাধব হালদারের (১৮৫৮-১৯২৩) ‘জাতিবিবেক’ (১৮৯৩), মহেন্দ্রনাথ করনের (১৮৮৬-১৯২৮) ‘A Short History and Ethnology of the Cultivating Pods’ (১৯১৯), ও হরকিশোর অধিকারীর ‘রাজবংশী কুলপ্রদীপ’ (১৯০৮) এই ধারাকে সমৃদ্ধ করেছিল। এই ধারারই অন্যতম সংযোজন হিসাবে মহেন্দ্রনাথের ‘ঝলমাল তত্ত্ব’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৪ সালে।

‘ঝলমাল তত্ত্বে’  মহেন্দ্রনাথ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন কেন ও কিভাবে উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজস্থানের মল্লগড় ও ঝালোয়ারা রাজ্য থেকে মল্লক্ষত্রিয়রা ভারতের দক্ষিণের মালাবার উপকূল (ওয়াস্টার্ন ঘাট) ও বঙ্গোপসাগর (ইস্টার্ন ঘাট) হয়ে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর মতে ক্ষত্রিয় জাতির বংশধর বাংলার মল্লক্ষত্রিয়রা মাছধরাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যা কোনোভাবেই নিন্দনীয় হতে পারে না। মাছের মূল যোগানদাতারূপে তাঁদেরকে হেয় চোখে দেখা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। তাঁর মতে প্রয়োজনের তাগিদে জাতিগত পেশাকে পরিত্যাগ করে অন্য পেশা গ্রহণ করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ব্রাহ্মণেরা পুরুষানুক্রমে চালিয়ে যাওয়া পৌরহিত্যের পেশা পরিত্যাগ করে অন্যান্য পেশা গ্রহণ করে ধনবান হচ্ছেন তাতে তাঁদের জাত নষ্ট হচ্ছে না। তাহলে বর্ণব্যবস্থার অন্যান্য বর্ণের মানুষেরা তাঁদের বর্ণগত পেশা ত্যাগ করলে তাঁদের কি জাতি পরিচয় নষ্ট হয়ে যাবে? ঝালমাল তত্ত্বের এই অনুসন্ধিৎসা নিঃসন্দেহে একটি মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, ঝালমাল তত্ত্ব জাতি বিষয়ক অন্যান্য পুস্তকের মতোই সাধারণ একটি পদক্ষেপ মাত্র। কিন্তু একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে যে, এই পুস্তিকাটি তার সমকালীন সমগোত্রীয় পুস্তকগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা। বেদে বর্ণিত ‘প্রকৃতি পুরুষের’ বিভিন্ন অঙ্গ থেকে বর্ণব্যবস্থা উৎপত্তি নিয়ে বহুচর্চিত শ্লোকটির মহেন্দ্রনাথ নতুন একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে প্রকৃতি পুরুষ কোন একজন ব্যাক্তি নন (যা প্রথাগত ব্যাখ্যায় লক্ষ্য করা যায়)। তিনি হলেন সমগ্র মানব গোষ্ঠীর সমাহার। তাঁর মতে ‘মানুষের জন্ম কারোর মুখ, বাহু, ঊরূ ও পদ থেকে হয় নি। পূর্বে কোন জাতি বা বর্ণ বিভাগ ছিল না। সকল মানুষই একজাতি বা এক বর্ণ ছিল। এরপর বহুদিন পরে কাজের সুবিধার একই মানবমন্ডলী গুণ ও কর্মানুসারে  ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র এই চারিভাগে বিভক্ত হয়।’ ভারত ও বাংলাদেশে মার্কসবাদী ও বস্তুবাদী ইতিহাসচর্চার সূচনার বহুপূর্বে ময়মনসিংহের ছত্রপুরে বসে মহেন্দ্রনাথ জাত-বর্ণব্যবস্থার যে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাকে এককথায় বৈপ্লবিক বলা যায়। শুধু তাই নয়, প্রাচীন ও ধ্রুপদী গ্রিক নগর রাষ্ট্রের উন্নত ব্যবস্থায় গুণ ও কর্মবিভাজনের ভিত্তিতে মহামতি প্লেটো মানবসমাজের যে শ্রেণিকরণ করেছিলেন, শতবর্ষ আগে মহেন্দ্রনাথের বিশ্লেষণে তারও প্রতিধ্বনি শুনত পাওয়া যায়।

ধর্মীয় ও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক বিন্যাসের চলমান  বাস্তবতার নিরিখে প্রণীত  ‘ঝালমাল তত্ত্ব’ একই পেশায় যুক্ত ভিন্ন ভিন্ন জাতির প্রতি বৈষম্যমূলক সামাজিক রীতিনীতির সমালোচনা করেছে। মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, মৎস্যজীবী গোষ্ঠীগুলো মাছ ধরে বিক্রি করে বলে তাঁদেরকে অপাংক্তেয় করে রাখা হয়েছে। অথচ উচ্চবর্ণীয়/উচ্চবর্গীয়রা মাছের ব্যবসায় যুক্ত হলেও তাঁরা সামাজিক বঞ্চনার শিকার হন না। তাঁর ভাষায়: “বর্তমান কালেও দেখিতে পাওয়া যায়, হোটেল ওয়ালা ব্রাহ্মণ, কায়েস্থ হোটেলে রান্না করিয়া পর্য্যন্ত মৎস্য মাংস বিক্রয় করিয়া থাকে। রেলগাড়ি বা জাহাজ হইতে নামিলেই তন্নিকটবর্তী হোটেলওয়ালা ব্রাহ্মণ মহোদয় দৌড়ে এসে বলে, ‘আমার হোটেলে চলুন, ডাল মাছ সকলই পাবেন। যদি ডাল ভাত খান, তবে বার পয়সা, - আর মাছ ভাত খাইলে চারি আনা।’ – এই সব মহাশয়গন কি মৎস্য বিক্রয়ী নয়?”

ঝালমাল তত্ত্বের এই প্রশ্নটি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় দলিত প্রতর্কের মূল যুক্তির সঙ্গে। লক্ষ করার বিষয় হল যে, বিশ শতকের শেষ ও একুশ শতকের গোড়ায় মহারাষ্ট্রের ‘দলিত প্যান্থারপন্থী’ নামদেও দাসাল থেকে শুরু করে হিন্দি সাহিত্য জগতের ড. তুলসীরাম ও ওমপ্রকাশ বাল্মিকীর সঙ্গে বাংলাদেশের অধ্যাপক হরিশংকর জলদাস ‘দলিত সাহিত্যের’ মাধ্যমে সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার সাহস দেখিয়েছেন। একইসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যতীন বালা,  মনোহর মৌলি বিশ্বাস, কাল্যানি ঠাকুর চাঁড়াল ও মনোরঞ্জন ব্যাপারী আত্মজীবনী রচনার মাধ্যমে তাঁদের অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করে চলেছেন। কিন্তু তার বহুপূর্বে ময়মনসিংহের মহেন্দ্রনাথ মল্লবর্মণ সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। স্বভাবিকভাবেই বলা যায় যে শতবর্ষ পূর্বে প্রকাশিত ঝালমাল তত্ত্ব সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেছিল যা তার পুনর্পাঠকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। তাছাড়া সম্প্রতি যে ৫০টি সম্প্রদায়কে ‘দলিত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (২০১৭) তাঁদের ইতিহাস জানার জন্যও মহেন্দ্রনাথের এই পুস্তিকাটির গুরুত্ব অপরিসীম। তদুপরি সমকালীন ভাবনার আলোক সমাজ, মানুষ, ও জাতি, প্রকৃতি বিষয়ক মৌলিক-ঐতিহাসিক প্রকাশনা/গ্রন্থ/রচনারই পুনর্পাঠ ও সমকালের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ/মূল্যায়ন একান্তভাবে জরুরী।

ড. রূপ কুমার বর্মণ, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর