একজন কাঠমিস্ত্রির ‘লাইব্রেরি’র গল্প

ঢাকা, জাতীয়

এস এম জামাল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 21:45:58

চারচালা টিনশেডের ঘর, পাকা মেঝে, ঘরের ভেতর ছোট্ট র‌্যাক, তাতে থরে থরে সাঁজানো গল্প, উপন্যাস আর কবিতার বই। রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসসহ হরেক রকমের বই। এই ঘরটিই এখন তাঁর জীবনের সব। এখানে জীবনের সঞ্চয় থেকে  গড়ে তোলা তার ‘কমিউনিটি লাইব্রেরি’।

বলছিলাম কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলা শহর থেকে ঢিল ছোঁড়া গ্রামের পাইকপাড়া-মির্জাপুর এলাকার কাঠমিস্ত্রি জসিম উদ্দিনের কথা।

জসিম উদ্দিন পড়ালেখা করেছেন ২য় শ্রেণি পর্যন্ত। শৈশবকালে বাবার নিরুদ্দেশের কারণে আর পড়ালেখা এগুতে পারেননি। তবে ছোটবেলা থেকে বইয়ের প্রতি যে দুর্বলতা এখনও রয়েই গেছে। পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও শিক্ষা ছাড়তে একবারেই নারাজ জসিম।

বইয়ের প্রতি নিজের আগ্রহের পাশাপাশি জ্ঞানের বিস্তার ঘটাতে উদ্যোগী হন তিনি। কাঠমিস্ত্রির কাজ করে যা আয় হয় তার একটি অংশ তিনি বইপ্রেমিদের জন্য বরাদ্দ রাখেন।

নিজের ঘরের আঙিনায় ২০১৬ সালের দিকে গড়ে তুলেছেন ছোট্ট একটি সংগ্রহশালা। যার নাম কমিউনিটি লাইব্রেরি। গল্প উপন্যাসসহ প্রায় হাজারখানেক বই রয়েছে এই লাইব্রেরিতে।

শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অবসর সময়ে এই লাইব্রেরিতে ছুটে আসেন বয়স্ক মানুষও। জসিম উদ্দিনের ছোট্ট এই লাইব্রেরী এখন পরিণত হয়েছে পরিপূর্ণ জ্ঞান পিপাসুদের আড্ডাখানায়।

নিজে পড়েলেখা করতে পারেননি তবে তাতে তার একটুও আফসোস নেই। কারণ এলাকার মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ফোটাতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করবেন বলে জানান জসিম। আর তাঁর এই মহৎ উদ্যোগের সারথি হয়েছেন তার সহধর্মিনী পপি খাতুনও।

লাইব্রেরিটি এখন বড় পরিসরে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। এজন্য দেশের বিত্তবানদের প্রতি উদাত্ত আহবানও জানান। তার এই ডাকে সাড়াও মেলেছে। অনেকেই তার এই লাইব্রেরি পরিদর্শন করে বই দিয়েছেন।

তিনি বই কেনেন নিজ খরচে, সদস্য সংগ্রহও করেন বিনা পয়সায়। ‘কমিউনিটি লাইব্রেরি’র সদস্য হতে কোনো ফিস লাগে না। সদস্যরা নানারকম বই পড়তে পারেন বিনামূল্যে। ধারও নিতে পারেন।

এলাকার পিছিয়ে পড়া সব বয়সী মানুষকে বই পড়তে উৎসাহ জোগাতেই জসিমের এমন উদ্যোগ বলেন জসিম উদ্দিন।

বইপ্রেমি এই মানুষটি জানান, আমার বয়স যখন ১০ বছর। তখন আমার বাবা মারা যান। সেই সময়ে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় আমাকে। পাশের বাড়ির এক কাঠমিস্ত্রির সাহায্যকারী হিসেবে কাজ শুরু করি। সেখান থেকে যা পেতাম তা দিয়েই সংসার চলতো। মাঝে মাঝে বই সংগ্রহ করে পড়তাম, অন্যকে পড়তে দিতাম। ধীরে ধীরে এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এক সময় একটা লাইব্রেরি গড়ার সিদ্ধান্ত নেই। শুরুতে আমার আগের পড়া কিছু বই আরও কিছু কিনে প্রায় ১০০-র মতো বই নিয়ে লাইব্রেরি শুরু করি।

মানুষকে বই পড়ানোর ব্যবস্থা করবেন এমন চিন্তা বিরাজ করছিলো তার মনের গহীণে। সেই স্বপ্ন পুরণ হয়েছে। তার বিশ্বাস, গ্রামের কম শিক্ষিত মানুষগুলো বই পড়ার মাধ্যমে অন্য এক উচ্চতায় যেতে পারবেন। জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি এখন বইয়ের ভিক্ষুক, মানুষ যেন আমাকে বই ভিক্ষা দেন।’

পাঠাগারটিতে বসার জায়গা না থাকার কারণে সবাই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বই পড়েন। আবার অনেকে বিকেল বেলায় মেঝেতে বসেই বই পড়েন। এলাকার সকল শ্রেণিপেশা ও বয়সের মানুষ তার এই লাইব্রেরির পাঠক।

বর্তমানে এ পাঠাগারে যারা পড়তে আসেন বা বই ধার নেন তারা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই তাঁর পাঠাগারের সদস্য হতে পারেন। তার কথায়, ‘শুধুমাত্র স্কুলের ছেলেমেয়েরা নয়, যারা অনার্সে পড়ে তারাও আমার পাঠাগার থেকে বই নেয়। এমনকি বয়স্ক এবং যেসব মেয়ের কিছুদিন হলো বিয়ে হয়েছে তারা সবাই আসে, বই নিয়ে যায়। আমার মতো খেটে খাওয়া মানুষরাও আসেন। এই লাইব্রেরিকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যেতে চাই বলে জানান তিনি।

খোকসা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ মো. সদর উদ্দীন খান বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে জসিমের এই কমিউনিটি লাইব্রেরি গড়ে তোলার বিষয়টি সত্যিই প্রশংসনীয়। জসিমের ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা এই লাইব্রেরির জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত লাইব্রেরির সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। একজন সামান্য কাঠমিস্ত্রি হয়েও জসিম এখন শুধু শিমুলিয়া গ্রাম নয়, গোটা খোকসা উপজেলার একজন আলোচিত মানুষ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর