মহামারি করোনাভাইরাস দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় এর সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত চারদিনের আংশিক লকডাউনের দ্বিতীয় দিনেও ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিসগামী সাধারণ মানুষ। গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় অফিসগামী মানুষের নির্দিষ্ট সময়ে অফিস পৌঁছাতে পোহাতে হয়েছে অনেক ঝাক্কি ঝামেলা।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মীকে আনার কথা থাকলেও বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তা মানেনি। আর এ কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে।
মঙ্গলবার (২৯ জুন) সরজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যাবহার করেন তারাও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অতিরিক্ত গাড়ির কারণে পড়েছেন দীর্ঘ যানজটে।
অপর দিকে যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই তারা যেকোন উপায়ে অফিস পৌঁছানোর জন্য বাস স্টপেজ দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
ঢাকার মিরপুর, বিমানবন্দর সড়ক, মহাখালী, ফার্মগেট, মালিবাগ, বাসাবো, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে দেখা গেছে, একমাত্র রিকশা ছাড়া অফিসগামীদের আর কোন বাহন নেই রাস্তায়। গতকাল পর্যন্ত পাঠাও চললেও মোটরসাইকেলে চালক ব্যতিত অন্য কাউকে না উঠানোর জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে নতুন করে নির্দেশনা জারি হওয়ায় মোটরসাইকেল চালকদের খুব একটা চোখে পড়েনি। তারপরেও কিছু চালক বাসস্টপেজ এর একটু আগে বা একটু দূরে থেকে দাঁড়িয়ে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের দিকে যেতে দেখা যায়। কিন্তু কর্তব্যরত পুলিশ তাদের কে দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন ভাবে আটকানোর চেষ্টা করেন।
সকাল থেকেই বাস স্টপেজ গুলোতে পরিবহনের জন্য প্রতীক্ষারত অফিসগামী যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। চাকরি বাঁচাতে যে কোন উপায়ে অফিসে যেতে রাস্তায় রিকশা, প্রাইভেট গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেলসহ মালবাহী পিকআপ ভ্যানের পিছেও ছুটতে দেখা গেছে অনেক মানুষকে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ কোন যানবাহন না পাওয়া অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েন অফিসগামী এই সকল মানুষ।
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী খালিদ মাহমুদের বাসা বকশি বাজার এলাকায়। বাসার সামনে থেকে শাহবাগ মোড়ে হেটে এসে প্রায় ১ ঘণ্টার মত তিনি দাঁড়িয়ে আছেন যানবাহন পাওয়ার আশায়। পরিবহন বন্ধ থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়ে তিনি বেশি ভাড়া দিয়ে রিকশা নিয়ে অফিসের পথে রওনা দিয়েছেন।
পথে যাওয়ার সময় তিনি বার্তা২৪.কম কে বলেন, দুই দিন আগেও শাহবাগ থেকে নাবিস্কো আসতে রিকশা ভাড়া ছিল ৬০ থেকে ৭০টাকা কিন্তু গতকাল থেকে আজকে পর্যন্ত ভাড়া লাগছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। করোনায় আমাদের আয় তো আর বাড়েনি উল্টো আমাদের মত স্বল্প আয়ের মানুষের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার লকডাউনে অফিস খোলা রেখে গণপরিবহন বন্ধ করে চাকরিজীবীদের করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সচেতনতা সম্পর্কে কি বোঝাতে চাচ্ছে সরকার তা আমার বোধগম্য নয় বলেও জানান তিনি।
ফার্মগেট এলাকায় যানবাহনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা তাহমিনা আক্তার বার্তা২৪.কম কে বলেন, অফিস খোলা রেখে লকডাউন দিয়ে সরকার ইচ্ছাকৃত আমাদের বিপদে ফেলেছে। প্রায় ১ ঘণ্টা হয়ে গেল দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু কোন যানবাহন পাচ্ছি না, অপর দিকে অফিস থেকে বলে দিয়েছে যেভাবে পারবেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই অফিসে আসতে হবে। কোন অজুহাত করা যাবে না। গতকাল বাধ্যহয়ে এই ফার্মগেট থেকে মিরপুর ১৪ হেঁটে গিয়েছি আজকেও মনে হয় হেঁটে যেতে হবে। অন্য দিকে এখন মাসের শেষ চাইলেও অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে রিকশায় যাওয়া সম্ভব নয়।
অপরদিকে উত্তরায় একটা বায়িং হাউজে চাকরি করা ওমর ফারুক জানান, রিকশা কিংবা পায়ে হেঁটে অফিসে গেলেও এটা ভাবার কোন সুযোগ নেই যে ঝামেলা শেষ। অফিস থেকে বাড়ি কি ভাবে ফিরব এটা আরেকটা বড় চিন্তার ব্যাপার।
তিনি বলেন, বাসা থেকে অফিস আসার জন্য যেমন ফজরের নামাজ পড়ার একটু পরেই বের হই তেমনি অফিস থেকে বাসায় পৌঁছাতে লেগে যায় রাত ৯ থেকে ১০টা। গতকাল সোমবার (২৮ জুন) আমার অফিস ছুটি হয়েছে বিকেল ৬ টায়। কিন্তু পথে কোন যানবাহন পাওয়া না যাওয়ায় কিছু পথ রিকশা কিছু পথ হেঁটে বাসায় পৌঁছাতে বেজে গেছে রাত দশটা। চাকরি ছাড়া ঢাকা শহরে বউ বাচ্চা নিয়ে চলার আর কোন উপায় না থাকায় অনেকটা অসহায় অবস্থায় সব কিছু সহ্য করতে হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওমর ফারুক।
অপর দিকে রিকশা ভাড়া বেশি নেওয়ার বিষয়ে জাকারিয়া নামের সিটি কলেজের সামনে এক রিকশাওয়ালা বলেন, যেভাবে রাস্তায় মানুষ বের হয়েছে সেই পরিমাণ রিকশা নেই, ফলে তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে অফিসগামীরাই ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কারণ ভাড়া কম বেশির চিন্তার চেয়ে অফিস পৌঁছানোই তাদের কাছে বড় চিন্তার বিষয়।
পাঠাও চালক হাবিবুর বলেন, কালকেও তো দেখেছেন আমরা যাত্রী আনা-নেওয়া করেছি, কিন্তু আজকে পুলিশ আইন করে নিষেধ করলেও কিছুটা বাধ্য হয়ে কৌশলে রাস্তায় এসেছি। বাইক নিয়ে না আসলে পরিবার পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। প্রতিদিন যা আয় করি তা দিয়েই তো সংসার চলে। ভাড়া বেশি নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ ধরলে প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মামলা দেয়। আর অন্য দিকে অফিসগামীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সঠিক সময়ে অফিস পৌঁছে দিতে পারায় ভাড়া একটু বেশি নেওয়া দোষের কিছু নয়।
শ্যামলীতে একটি বেসরকারি মেডিকেল হাসপাতালের কর্মকর্তা আশ্রাফ আলী আজিমপুর থেকে হেঁটেই রওনা দেন কর্মস্থলের দিকে। পথে তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে যার যার অবস্থান থেকে তো একটু ছাড় দিতেই হবে। কর্মও করতে হবে পাশাপাশি সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরকারকে সাহায্যও করতে হবে। গতকালই দেখেছি রাস্তায় জ্যাম আর রিকশায় নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া, তাই সকালে একটু বেশি সময় নিয়ে হেঁটেই বের হয়েছি অফিসের উদ্দেশ্যে।
ফার্মগেট এলাকার ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সার্জেন্ট আরিফ বার্তা২৪.কম কে বলেন, রাস্তায় বের হওয়া ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে শুরু করে মোটরসাইকেল আরোহী সবাইকে কম বেশি আমরা বাইরে বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করছি। প্রয়োজন শুনে কিছুটা মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা ছেড়ে দেওয়ায় চেষ্টা করছি। তারপরেও সকাল থেকে অন্তত ৫ জনকে মামলা দিয়েছি।অহেতুক বাইরে বেড়াতে যাওয়ার অভিযোগে একজন, হেলমেট না থাকা, তিন জন এক বাইকে উঠা সহ সংশ্লিষ্ট কারণে মামলা দেওয়া হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ মানুষকে আমরা সচেতন করার চেষ্টা করেছে ভবিষ্যতে তারা যেন আর ভুল না করে।
অপর দিকে, সাইন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করা পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বার্তা২৪.কম কে বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে গতকাল থেক শুরু হওয়া আংশিক লকডাউনে গণপরিবহনের ঝামেলা নেই রাস্তায়, অপ্রয়োজনীয় কাজে মানুষ যাতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের না হয় সে জন্য কাজ করছি আমরা।অপরদিকে মোটরসাইকেলে চালক ব্যতিত অন্য কোন আরোহী যাতে যেতে না পারে তার দিকে খেয়াল করছি আমরা। জরুরি কাজে জড়িত ডাক্তার-গণমাধ্যম কর্মীদের পরিবহনে ছাড় দেওয়া হচ্ছে।
আইন অমান্য করে পাঠাও চলার বিষয়ে তিনি জানান, আমাদের অবস্থান দেখে অনেকে বাইক থেকে নেমে একটু দূরে গিয়ে উঠছেন, যেটা আমাদের পক্ষে ধরা সহজ হচ্ছে না। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি আমরা বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সোমবার (২৮ জুন) সকাল ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) সকাল ৬টা পর্যন্ত আংশিক লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। এই সময়ে সারা দেশে রিকশা ছাড়া যাত্রী পরিবহনে আর কোনো বাহন চলবে না বলে প্রজ্ঞাপনে নিশ্চিত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।