এখনো বাড়ি যাচ্ছেন তাঁরা!

, জাতীয়

নাজমুল হাসান সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-27 20:39:10

একটু আগের ঝুম বৃষ্টি শেষে দুপুরে কড়া রোদ উঠেছে। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা, টুকটাক রিকশা চলছে আর কিছু ব্যক্তিগত যান। এসবের মধ্যে ঢাবির কার্জন হল ঘেষা রাস্তা দিয়ে একদল মানুষ ঘাড়ে,মাথায় বা হাতে ছোট বড় ব্যাগ নিয়ে ঢামেকের দিকে হাটছে। দূর থেকে দেখে আন্দাজ করা যায় এনারা কৃষি শ্রমিক। হয় কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন, না হয় কাজ শেষ করে বাড়ির পথ ধরেছেন।

শুক্রবার দুপুরে এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে কথা হয়। ১২ থেকে ১৩ জনের এই শ্রমিকদলের একজন আলতাফ বেপারি। তিনি বার্তা২৪.কম-কে জানান, আমরা ছিলাম রুপগঞ্জে।সেখানে ক্ষেতির কাজ করতাম।এখন কাজ শেষ তাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি।আমরা সবাই বগুড়ার ধুনট থানার বাসিন্দা।সব কিছু বন্ধ এর মধ্যে কিভাবে আসলেন ঢাকা পর্যন্ত? এমন প্রশ্মের জবাবে তিনি বলেন,আমরা রিকশা,অটো, ভ্যান আর পায়ে হেটে রুপগঞ্জের আড়াই হাজার থেকে ঢাকা পর্যন্ত এসেছি।এখন গাবতলী যাব।ওখান থেকে কোন না কোনভাবে বগুড়া যাইতেই পারব।

পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন তিনি

বৃহস্পতিবার লকডাউনের প্রথম দিন গাবতলী বাসস্ট্যান্ড ও ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা। নাঈম, রাজু ও শাকিল নামে সমবয়সী তিন কিশোরকে ঘাড়ে বিশাল বিশাল ব্যাগ নিয়ে ঘুরতে দেখা যায়। প্রশ্ন করে জানা যায়,তারা কর্মহীন হয়ে ঢাকা থেকে বাড়ির পথ ধরেছেন। হেমায়েতপুরের একটি স্যানিটারি কারখানায় কাজ করতেন নরসিংদীর এই তিন কিশোর। এই সময় কারখানা বন্ধ থাকায় তাদের বাধ্য হয়েই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে বলে জানান তারা।

রাজু বার্তা২৪.কম-কে বলেন, হুট করে কারখানা বন্ধ করে দিয়ে মালিক বললো বাড়ি চলে যাও।আমরাও ব্যাগ নিয়া বাইর হয়ে গেলাম। সেই আটটা থেকে বসে আছি গাড়ির অপেক্ষায় কিন্তু কোন গাড়ি নাই।এতক্ষণ হাইটা গেলেও অর্ধেক রাস্তা চইলা যাইতাম।এই লকডাউন আমাগো চরম বিপদে ফালাইছে।

গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন তারা

ষাটোর্ধ্ব আব্দুল হাই দম্পতি ঘুরছেন গাবতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। গন্তব্য টাঙ্গাইল। কোথায় যাবেন জানতে চাইলে আব্দুল হাই উত্তর দেন, “নাম আমার আব্দুল হাই, বাইত যামু গতি নাই।” ভোগান্তিকে কটাক্ষ করতেই বুঝি তার এমন উত্তর।

কিছুদূর হেঁটে, কিছুদূর রিকশায় কিংবা কিছুদূর প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রাকে বা পিকআপে বাড়ি যাচ্ছেন এসব মানুষ।

শনিবার (০৩ জুলাই) গাবতলীতে দেখা মিলে আরও তিন কিশোরের, পেশায় তারা নির্মাণ শ্রমিক। কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি নির্মাণাধীন ভবনে। গতকাল বিকেলে কাজ বন্ধ হওয়ার পর তাঁরা চাপাইনবাবগঞ্জেরর নাচোলে গ্রামের বাড়িতে যাবেন বলে ঘুরছেন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তিন বন্ধু মো. রনি ইসলাম, মো. রাসেল ও মো. জনি মিলে আমিনবাজার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। রনি বললেন, “গতকাল রাত সাড়ে নয়টা থেকে ঢাকায় ঘুরতেছি, কমলাপুর, যাত্রাবাড়ী গেছিলাম। রাতে আমরা যাত্রাবাড়ি আমের আড়তে ছিলাম। বাড়ি যাওয়ার কিছুই পাই না।”

গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেছেন তারা

আরেক বন্ধু রাসেল বলেন, “গতকাল নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতে, ঘুরতে দুই হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। বাকি পথ ভেঙে বাড়ি গেলে হাতে বিশেষ কিছুই থাকবে না আর। ট্রাক খুঁজতেছি আমরা। ঢাকায় তো আমাদের থাকার জায়গা নেই।”


চলমান সাতদিনের বিধিনিষেধের তৃতীয় দিন আজ শনিবার। সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে গতকালের তুলনায় মানুষের উপস্থিতি কিছুটা কম দেখা গেছে। রাজধানীর বিশ্বরোড, শাহবাগ, ফার্মগেট, আসাদগেট, টেকনিক্যাল ও গাবতলীতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেকপোস্ট ছিল। এসব চেকপোস্টে প্রশাসনের কড়াকড়ি ছিল। চেকপোস্টগুলোতে যাতায়াতের কারণ জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে।

যাদের রাজধানীতে জীবিকার প্রয়োজনে থাকতে হয়, তারা আজ ঢাকা ছাড়ছেন। রাজধানীর গাবতলীতে বেলা সাড়ে ১২টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত অন্তত ১৪ জনকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

আমিনবাজার ব্রিজে কথা হয় হাজারিবাগের রিকশাচালক আলতাফ হোসেনের সাথে। তিনি যাবেন সিরাজঞ্জের চোহালী থানার গ্রামের বাড়িতে। যাওয়ার জন্য তিনি ট্রাক খুঁজছেন। তিনি বলেন, “হাজারিবাগ থেকে রিকশায় এসেছি। এখন হাঁটতেছি। ট্রাক খুঁজতেছি। বাড়ি যেতেই হবে। সেখানে পরিবার আছে। আর বাড়িতে একটা গরু আছে। ওইটাকে এবারের ঈদে বিক্রি করবো। দেখার লোক নাই।”

ছবিঃ বার্তা২৪.কম

গাবতলী রাজধানীতে ঢোকার অন্যতম প্রবেশমুখ। ভোর ছয়টা থেকে এখানে ঢাকায় ঢুকতে ও বের হতে হলে পুলিশের চেকপোস্টের মুখে পড়তে হচ্ছে। জরুরি কারণ দেখাতে না পারলে মামলা দেওয়া হচ্ছে। কাউকে আটকও করা হচ্ছে। এই চেকপোস্টে কাজ করছেন দারুস সালাম ট্রাফিক দারুস সালাম জোনের সার্জেন্ট হারুন অর রশীদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, গাবতলী চেকপোস্ট থেকে কোনোভাবেই কেউ চেক ছাড়া যেতে পারছে না। কেউ যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, মামলা দেওয়া হচ্ছে। অনেকে মোটরসাইকেলে একের অধিক যাচ্ছে। জরুরি হলে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, নয়তো মামলা দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, “কোনো পিকআপ বা ট্রাকে করে কাউকে গাবতলী থেকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। অনেকে ব্যাগ হাতে হেঁটে সেতু পার হচ্ছেন। পার হয়ে তারপর ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাড়ি যাচ্ছেন।”

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে আজ মানুষ ও বাহনের উপস্থিতি কম ছিল। তবে বেলা বাড়তে তা কিছুটা চোখে পড়েছে। নগরীর প্রধান সড়কের তুলনায় রাজধানীর অলিগলিতে মানুষের জটলা কিছুটা বেশি চোখে পড়েছে।

সকালে খিলগাঁও বিশ্বরোডে কথা হয় খিলগাঁও থানার ইনসপেক্টর দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, চলমান বিধিনিষেধে গত দুদিনের তুলনায় এ সড়কে মানুষের যাতায়াত আজ কম।

তিনি আরও বলেন, মানুষ এখন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মূল সড়কে কম আসছেন। বেলা ১১টা পর্যন্ত তিনি তিনজনকে মামলা দিয়েছেন। একজনের অপরাধ মোটরসাইকেলে ভাড়ায় চলছিলো। বাকি দুজন যাতায়াতের যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারেননি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর