দাওয়াত নেই, পত্র নেই, তবুও...

খুলনা, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 16:54:51

দাওয়াত নেই, পত্র নেই, তবুও সাঁইজির এক উদাসীর টানে এই ধামে সাধু-গুরু বাউল ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড়ই বেশি। সাঁইজির ১২৮তম তিরোধান দিবসে ভক্ত-অনুসারীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে আখড়াবাড়ি। একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাঁশির সুরে মুখরিত হয়ে উঠেছে লালনভূমি ছেঁউড়িয়া। তিরোধান দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৬ অক্টোবর) শুরু হয় তিনদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠান।

বুধবার (১৬ অক্টোবর) সকালে বাল্যসেবার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দিনের মতো কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়াবাড়িতে সাধুদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

তবে লালনের মর্মবাণী বোঝা কঠিন, বুঝতে হলে একজন গুরুর সান্নিধ্যে আসতে হবে। দর্শনার্থীরা মনে করেন, বই পড়ে লালন সম্পর্কে জানা কঠিন, লালন সম্পর্কে জানতে হলে সাঁইজির ধামে আসতেই হবে। আর এমনটাই জানালেন লালন সাধকরা।

লালনের তিরোধান দিবসের প্রথম দিন মঙ্গলবার দুপুর থেকেই আখড়াবাড়ির বাউল আঙিনা কানায় কানায় ভরে উঠে। পুরো এলাকার সবটুকু ফাঁকা স্থান ভরে গেছে। ছোট ছোট করে আস্তানা গেড়েছেন বাউল ও ভক্তরা। বুধবার ভিড় যেন জনস্রোতে পরিণত হয়েছে। এ এক সাধুদের মিলন মেলা। সকালে রাখালসেবা বা বাল্যসেবা নিয়ে শুরু হয় গান।

সকালের অধিবাসে পায়েস ও মুড়ি দিয়ে বাল্যসেবা গ্রহণ করেন ভক্তরা। দুপুরে তারা মরা কালীগঙ্গায় গোসল সেরে মাছ-ভাত ও ত্রিব্যঞ্জন (তিন ধরনের সবজি দিয়ে তৈরি তরকারি) এবং দধি খান।

পূণ্যসেবা গ্রহণকে কেন্দ্র করে দুপুর ১টায় লালন একাডেমির প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়।

লালনের উন্মুক্ত মঞ্চ ছাড়ও পুরো মাজার চত্বর একতারা আর ডুগির শব্দে মুখর হয়ে উঠে। সাধুসঙ্গের পর রাতে বাউলেরা অধিবাস শুরু করবেন। সাঁইজির আরাধনায় মত্ত হবেন।

সাধুর হাটের সদাই কিনে পরমাত্মায় আত্মা মেলাবে সাঁইজি প্রেমের রসিকরা। ধূপের ধোঁয়ায় পবিত্র হচ্ছে সাঁইজির ধাম। ঢাকের বাড়িতে মন দোলাচ্ছে খ্যাপা-খ্যাপিরা।

১২৭ বছর আগে ধরা থেকে দেহলীলা সাঙ্গ করেছেন বাউলিয়ানার শুদ্ধ পুরুষ লালন ফকির। মানবধর্মের দিশারী ফকির লালনের দেহাবয়ব নেই দুনিয়ায়, তবে ভক্ত-অনুরাগীদের মননে আজও তিনি জীবিত।

গান, দর্শন আর সৃষ্টিতত্ত্বে লালন মানেই মানুষের জয়গান। মানুষ-ই লালন দর্শনের কেন্দ্র। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ পাবি’ এমন ভজন তত্ত্ব অন্য সাধে মেলানো ভার। মানুষেই সৃষ্টি, মানুষেই স্রষ্টা, তা লালনের মতো আর কেউ সহজ করে বলতে পারেনি এ ধরায়।

বাউল আফজাল শাহ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘সাঁইজির দর্শন পেতে এখানে আসা। এখানে আসলে মনে প্রাণের তৃপ্তি পাওয়া যায়। আমরা গুরুদের মুখ থেকে শুনি সাঁইজির বাণী।

বাউল সাধক হৃদয় শাহ বার্তা২৪.কমকে জানান, গোষ্ঠ গান শুরু করতে হয় দিনের শুরুতে। যখন সূর্য উঠবার আগে আকাশ অন্ধকার থেকে লালরূপ ধারণ করে ফর্সা হতে শুরু করে তখনই গোষ্ঠ গান গাইবার চল আছে।

তিনি বলেন, ‘সাধু-বাউলদের নাড়ির টানেই সবাই আসে। সাঁইজির ভক্তি করতে পারার সৌভাগ্য কজনের ভাগ্যে জোটে? তার প্রেমেই এখানে আসি।’

লালন মাজারের খাদেম মহম্মদ আলী শাহ বার্তা২৪.কমকে জানান, চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে সাঁইজির তিরোধানের আয়োজনের তিনটি পর্ব থাকে। পয়লা কার্তিক রাতে হয় ‘অধিবাস’। এই পর্বে সাধুসঙ্গের পর রাতে বাউলদের খিচুড়ি খেতে দেওয়া হয়। পরদিন সকাল শুরু হয় গোষ্ঠ গানের মধ্য দিয়ে। দিনকে স্বাগত জানানোই গোষ্ঠ গানের মূল উদ্দেশ্য। ‘তুমি গোষ্ঠে চলো হরি মুরারি, আর আমারে মারিসনে মা’ এসব গান পরিবেশন করা হয়। লালন সাধুগুরু, ভক্ত অনুসারী ও আখড়াবাড়ির সবাই অংশগ্রহণ করে এই গোষ্ঠ গানে।

তিরোধান দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ভক্তরা এ উৎসব পালন করতে সমবেত হয়ে থাকে। এবারো তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এ সময় আঁখড়াবাড়ি দেশ-বিদেশ থেকে আগত লক্ষ প্রাণের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠে।

মাজার প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, বাউলরা বসেছেন আপন ঘরানায়। দল বেঁধে বসে তত্ত্ব আলোচনায় ব্যস্ত বাউল সাধকরা। সকাল থেকে শুরু হয় লালন সাঁই ও অন্য সাধু-গুরুদের গানের বিশ্লেষণপর্ব। গাওয়া হয় ‘কোথায় হে দয়াল কাণ্ডারি, এসো হে ওপারের কাণ্ডারি, রাখিলেন সাঁই কুপজল করে আন্ধেলা পুকুরে।

এদিকে বাউল সম্রাটের জীবন ও কর্মের উপর নিয়মিত আলোচনা চলবে বুধবারও। বুধবার সন্ধ্যায় কুষ্টিয়ার কালিগঙ্গা পাড়ে লালন মঞ্চে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আলোচনা শেষে লালন শিল্পীদের সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর