ভাঙলো সাধুর হাট….

খুলনা, জাতীয়

এস এম জামাল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 08:52:05

ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি থেকে: আমার বন্ধু দয়াময়, তোমারে দেখিবার মনে লয়, তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে….।

বিরহের সুরে ভাঙলো কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে বাউল সাধুদের মিলনমেলা ‘সাধুর হাট’। সাধক ফকির লালন সাঁইজির ১২৮ তম তিরোধান দিবসে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে মানুষের ঢল নামে।

সাঁইজির প্রাণের টানে এই ধামে সাধু-গুরু বাউলেরা ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড়ই বেশি দেখা গেছে।

মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া সাধু সংঘ শেষ হয়েছে বুধবার দুপুরে। বুধবারেই এবারের মতো ভেঙেছে সাধুর হাট। বাউলের চারণভূমিতে আসা হাজার হাজার লালন-ভক্ত, সাধু-গুরু সকালের অধিবাসে পায়েস ও মুড়ির বাল্যসেবা গ্রহণ করেন। দুপুরে তারা মরা কালী গঙ্গায় গোসল সেরে দুপুরের খাবার পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। লালন একাডেমির সভাপতি ও কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো: আসলাম হোসেন উপস্থিত থেকে পুণ্যসেবার আনুষ্ঠিকতার উদ্বোধন করেন। পুণ্যসেবার মধ্যে ছিল ভাত, মাছ, তিন পদের সবজি তরকারি ও দধি।

বাউলরা বিশ্বাস করেন শুদ্ধ আত্মায় মুক্তি। আর মুক্তির আশায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধু সংঘে ছুটে আসা। বুধবার দ্বিতীয় দিন ভোরে গোষ্ঠ গানের মধ্য দিয়ে বাউলদের দিনের আচার অনুষ্ঠান শুরু হয়।

লালন একাডেমি সূত্রে জানা যায়, ভোরে গোষ্ঠ গানের মধ্য দিয়ে তিরোধান দিবসের দ্বিতীয় দিন শুরু হয়। দিনকে স্বাগত জানানোই গোষ্ঠ গানের মূল উদ্দেশ্য। এরপর একে একে অনুষ্ঠিত হয় তাদের কার্যকরণ। গুরু-শিষ্যের ভাব আদান প্রদান, লালন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা আর সেইসঙ্গে নিজস্ব ঘরনায় বসে চলে লালনের গান পরিবেশন। ‘তুমি গোষ্ঠে চলো হরি মুরার’, ‘আর আমারে মারিসনে মা’ এসব গান পরিবেশন করা হয়। এরপর ‘বাল্যসেবা’। পর্বে সকালে ‘ভোগগ্রহণ’ করেন অনেকে। তারপর পায়েস-মুড়ি খেতে দেয়া হয়। ভোগগ্রহণের পালা শেষে গানবাজনা, তত্ত্ব-আলোচনা চলতে থাকে। বুধবার দুপুরে হয় ‘পূর্ণসেবা’। একাডেমি কর্তৃপক্ষই এসবের আয়োজন করেছেন।

প্রায় ৫ হাজার বাউল ভক্ত দর্শনার্থীরা একসঙ্গে বসে ত্রিব্যাঞ্জন দিয়ে “আল্লা আলেক” এর নাম করে পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। পুণ্যসেবায় ভাত, সবজি, মাছ, ডাল ও মিষ্টান্ন খেতে দেয়া হয় বাউলদের। এই সেবার মধ্য দিয়ে শেষ হয় বাউলদের অষ্ট প্রহরের সাধু সংঘ। এদিকে সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় লালন সাঁই ও অন্য সাধু-গুরুদের গানের বিশ্লেষণপর্ব। গাওয়া হয় ‘কোথায় হে দয়াল কাণ্ডারি, এসো হে ওপারের কাণ্ডারি, রাখিলেন সাঁই কুপজল করে আন্ধেলা পুকুরে’।

ফকির হৃদয় শাহ জানান, সাঁইজির ধামে বছরে দুটি অনুষ্ঠানে নয়, পার্থিব জীবনে এই মর্মবাণী উপলব্ধি করতে হবে সবাইকে। আয়োজনে যোগ দেয়ার জন্য বাউলদের কোনো চিঠি দেয়া হয় না, জানানো হয় না নিমন্ত্রণ। তারপরও এক অদৃশ্য সূতোর টানে এরা দলে দলে ছুটে আসেন এ বাউল ধামে। প্রাপ্তি যাই হোক না কেন নিজেকে শুধরিয়ে আত্মশুদ্ধি অর্জন করায় তাদের মূল উদ্দেশ্য। তবে অনেকে আবার লালনের মূল আদর্শের তত্ত্ব মেনে বাউল ভক্তদের আনুষ্ঠানিকতা পালনের আহ্বান জানান।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বাউলভক্তরা জানান, সাঁইয়ের জীবদ্দশায় শুধুমাত্র তার ভক্ত আর শিষ্যদের নিয়ে আড়াই দিনের উৎসব করতেন। সেই নিয়ম মেনেই বাউলরা ভাটায় আসেন, উজানে ফিরে যান যে যার আপন নিবাসে। প্রকৃত বাউলরা সরকারি অনুষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজ-খবরও রাখেন না। তাদের মঞ্চে ডাকলেও তারা আসন ছেড়ে উঠেন না। লালন আখড়ার আশপাশে ও একাডেমির নিচে যারা আসন গাড়েন তারা সাঁইকে ভক্তি আর আরাধনায় নিমগ্ন থাকেন। কখনো স্থান ত্যাগ করেন না।

এদিকে সাধক লালন ফকিরের জীবন ও কর্মের ওপর নিয়মিত আলোচনা সভার সমাপনী দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া। পরে লালন মঞ্চে চলে রাতভর লালন সঙ্গীত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর