রোগে নয়, শিশুরা বেশি মারা যাচ্ছে পানিতে ডুবে

, জাতীয়

আনিসুর বুলবুল | 2023-08-31 13:13:06

সাড়ে তিন বছরের আদনান। বাড়ির উঠানে খেলাধুলা করছিল। একপর্যায়ে সে ডোবার পানিতে পড়ে তলিয়ে যায়। খোঁজাখুঁজি করে মৃত অবস্থায় তার লাশ সেখান থেকে উদ্ধার করেন তার স্বজনেরা। ঘটনাটি ঘটে ২০ জুলাই সুনামগঞ্জের ধরমপাশায়।

চম্পক চাকমা ও পরাণ চাকমা দুই ভাই বোন। দাদা বাড়ি থেকে ফেরার পথে ডোবার পানিতে ডুবে যায়। পরে খোঁজাখুঁজি করে ডোবা থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ঘটনাটি ১০ জুলাইয়ের খাগড়াছড়ির।

কমলার বয়স ৬ আর জান্নাতের বয়স ৪; দুই বোন। বাড়ির পাশে মাটি বিক্রি করা একটি বড় গর্তের পাশে তারা খেলা করছিলো। পরে সেই গর্ত থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ঘটনাটি ২০ জুনের কক্সবাজারের টেকনাফের।

সাত বছরের হাওয়া বিবি। বাড়ির পাশে খেলা করছিল। বিকেলে বাড়ির লোকজন তাকে বাড়ির পাশে একটি ডোবার পানিতে ভাসতে দেখে। খবর পেয়ে পুলিশ ও স্থানীয়রা তাকে মৃত উদ্ধার করে। ঘটনাটি ৫ জুলাইয়ের ময়মনসিংহের গৌরীপুরের।

আঠারো বছরের তানভীর শুভ। ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। ফুটবল খেলা শেষে পুকুরে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যায়। এরপর ডুবুরি দল তার মরদেহ উদ্ধার করে। ঘটনাটি ২৩ জুলাইয়ের যশোরের।

সাড়ে তিন বছরের আদনান, ভাই বোন চম্পক-পরাণ, দুই বোন কমলা-জান্নাত কিংবা আঠারো বছরের তানভীর শুভ নয়! দেশে গত ১৯ মাসে এক হাজার ৩৩২ জনের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৭০ শতাংশই আবার ১০ বছরের কম বয়সের। জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে। এমনকি রোগে ভুগে মৃত্যুর চেয়ে দেশটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারই বেশি বলে মনে করেন গবেষকরা।

গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান 'সমষ্টি' এ চিত্র তুলে ধরেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৩ জুলাই পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ রবিবার (২৫ জুলাই) দেশে প্রথম বারের মতো পালিত হচ্ছে 'বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস।' দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে— 'যে কেউ পানিতে ডুবে যেতে পারি, সবাই মিলে প্রতিরোধ করি।'

গত ২৮ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক রেজুলেশন গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ২৫ জুলাইকে বিশ্ব 'পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ' দিবস ঘোষণা করে।

'সমষ্টি'র তথ্যে দেখা গেছে, গত ১৯ মাসে কুড়িগ্রাম জেলায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর সর্বাধিক ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত এই জেলায় ৬৩ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের মধ্যে ৪৫ জনের বয়স ৯ বছরের কম। পরিবারের সদস্যদের অগোচরে এসব শিশু পানির সংস্পর্শে গিয়ে মারা যায়।

অন্যদিকে দেশের আট বিভাগের মধ্যে গত ১৯ মাসে পানিতে ডুবে সর্বাধিক শিশুর মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এ সময় এই বিভাগের জেলাগুলোয় অন্তত ২৭১ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২৮টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ঢাকা বিভাগে।

পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে জাতীয়ভাবে সর্বশেষ জরিপ হয়েছে ২০১৬ সালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপে তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী প্রতি বছর সব বয়সি প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ আনুমানিক ১৪ হাজার ৫০০ জনই ১৮ বছরের কম বয়সি।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের পরিচালক ও ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টারের ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর ড. আমিনুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার পানিতে ডুবে যাওয়াকে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রাসমূহ (এসডিজি), বিশেষত এসডিজি ৩- সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ, অর্জনের লক্ষ্যে শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরি।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জনসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক পাঁচ বছরের নিচে ২ লাখ শিশুর সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৮ হাজার কমিউনিটি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানোর একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে শিশুদের এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু প্রতিরোধে যত দ্রুত সম্ভব এসব কার্যক্রম দেশব্যাপী পরিচালনা করার এখনই সময়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর