তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের প্রায় এক যুগ পার হলেও স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার কার্যকর করার ক্ষেত্রে এখনও সরকার, নাগরিক সমাজ, বেসরকারি সংগঠন ও গণমাধ্যমের সমন্বিত প্রচারণাসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগের ঘাটতি বিদ্যমান।
বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) ‘তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ চর্চার মূল্যায়ন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
একইসাথে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণে ১১ দফা সুপারিশ প্রদান করেছে সংস্থাটি।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সমন্বয়ক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২০ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ১৯২টি প্রতিষ্ঠানের (১৫৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ৩৯টি এনজিও) ওয়েবসাইটের ওপর তথ্য সংগ্রহ করে মিশ্র পদ্ধতিতে এই গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়েছে। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে স্কোরিং করা হয়েছে। নির্ধারিত তিনটি ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত মোট ২৫টি নির্দেশকের (তথ্যের ব্যাপ্তিতে ১৯টি, প্রবেশগম্যতায় ৪টি ও উপযোগিতায় ২টি নির্দেশক) ভিত্তিতে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ চর্চার মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাপ্ত চূড়ান্ত স্কোরের শতকরা হারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্তোষজনক (৬৭-১০০ শতাংশ), অপর্যাপ্ত (৩৪- ৬৬ শতাংশ) এবং উদ্বেগজনক (০-৩৩ শতাংশ) এই তিনটি গ্রেডিংয়ে ভাগ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে অগ্রগতি যথেষ্ট সন্তোষজনক নয়। তথ্যের প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক অবস্থা দেখা গেলেও তথ্যের ব্যাপ্তি ও উপযোগিতার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানেই আরও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে বিধিমালা অনুযায়ী অনেক তথ্য প্রকাশিত হলেও তথ্যের হালনাগাদকরণ এবং ধরন অনুযায়ী তথ্যের বিন্যাস, বিস্তৃতি ও তথ্যপ্রাপ্তির সহজলভ্যতার ক্ষেত্রে এখনো ঘাটতি বিদ্যমান। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে বিধিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি লক্ষণীয়। এছাড়া ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় ধারণার ঘাটতিও বিদ্যমান।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে যেমন সরকারি ও বেসকারি সংস্থাসমূহের ভূমিকা ছিল, তেমনি এটির সুষ্ঠু বাস্তবায়নের কাজটিও সরকারি ও বেসকারি সংস্থাসমূহের। আইনটি প্রণয়নের ১১ বছর পর এসে তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ আগের তুলনায় বাড়লেও সার্বিকভাবে এবং মোটা দাগে তা সন্তোষজনক নয়। স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের বিষয়টি আইনগত গুরুত্ব পেলেও তার চর্চা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। এই গবেষণার প্রতিটি মাপকাঠিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও তাদের আরও উন্নতির সুযোগ ছিল। সরকারি ও বেসরকারি- উভয় ক্ষেত্রেই স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার গুরুত্ব পায়নি এবং এর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়নি। এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটই নেই। এতে করে জনগন প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তথ্য অধিকার আইনের সুফল হিসেবে স¦চ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়ার কথা থাকলেও তা পরিপূর্ণভাবে হচ্ছেনা।”
তথ্য অধিকার আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের চর্চা বৃদ্ধিতে ১১ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছে- প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার নির্দেশিকা প্রণয়ন করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এবং নির্দেশিকার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে তদারকি বৃদ্ধি করা; সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, সেবা ও সেবা প্রদানকারীর তথ্য, কর্মকর্তা কর্মচারীর ক্ষমতা ও দায়িত্ব ইত্যাদি হালনাগাদ তথ্য বিধি অনুযায়ী গুরুত্ব সহকারে প্রকাশে আরও উদ্যোগী হওয়া; তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত আবেদনকৃত তথ্যের ধরন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তথ্যের ঘাটতি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষণ করে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশের ব্যবস্থা করা; প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত তথ্য ও কার্যক্রম সম্পর্কিত অভিযোগ দায়েরের জন্য ওয়েবপেইজে সুুনির্দিষ্ট স্থান রাখা এবং অনলাইনের মাধ্যমে কার্যকর নিষ্পত্তি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় ও নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রচলিত ফন্টে (ইউনিকোড) প্রকাশ করা; ওয়েবসাইট ব্যবস্থাপনা বিভাগের জনবলের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে এবং ওয়েবসাইটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীসহ ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার সম্পর্কে জ্ঞান ও দক্ষতাবৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা; ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা এবং হালনাগাদকরণের তারিখ উল্লেখ করা; প্রতিবন্ধীদের সংশ্লিষ্ট সেবা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করা, ওয়েবসাইটকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার উদ্দেশ্যে ভয়েস অ্যাক্টিভেটেড ব্যবস্থা প্রবর্তন করা; তথ্য কমিশনসহ তথ্য অধিকার অ্যাক্টিভিস্ট ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে সমন্বিত প্রচারণার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বৃদ্ধি করা; তথ্য প্রকাশ ও প্রচারে প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানসমূহের দক্ষতা ও সক্ষমতা পর্যবেক্ষণের জন্য তথ্য কমিশনের ক্ষমতা ও তদারকি বাড়ানো, এবং তদারকি কার্যক্রমে নাগরিক সমাজ ও জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করা।