স্বাস্থ্যমন্ত্রী অসহায়!

, জাতীয়

শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 14:26:48

‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ কথাটি যেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লকডাউন ঘোষণা আবার লকডাউন তুলে নেওয়া। গার্মেন্টস বন্ধ আবার গার্মেন্টস খোলা। শ্রমিকদের আসতে বলে বাস বন্ধ করা। আবার গণটিকা কার্যক্রম চালু করে বন্ধ।

অন্যদিকে বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও কর্মকর্তাগণ আগ বাড়িয়ে কথা বলায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার দায়ও তাকে নিতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জামেল হক বলেছিলেন, ১১ আগস্টের পর ১৮ বছর ঊর্ধ্বে নাগরিকরা ভ্যাকসিন কার্ড ছাড়া বের হলেই শাস্তি,পরদিন অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করেন তিনি।

এসকল বিষয় নিয়ে জবাবদিহি করতে হচ্ছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক কে। বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) সংসদ ভবন অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো নিয়ে মন্ত্রীর কাছে জবাব চান সংসদীয় কমিটি।

এসময় মন্ত্রী অনেকটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন বলে জানা গেছে। মন্ত্রী কমিটির সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে বলেছেন, যা কিছু হয় তার অনেক কিছুই আমি জানি না। আসলে কিভাবে হচ্ছে আমি কিছু বুঝতেছি না। অনেক কিছু আমার কন্ট্রোলের বাইরে, এটা সে স্বীকার করছেন মন্ত্রী।

বৈঠকে মন্ত্রী বলেছেন, অনেক সিদ্ধান্ত হয় যেটা আমি জানি না। গার্মেন্টস খোলার বিষয়ে চোর পুলিশ খেলার মতো অবস্থা তুলে ধরলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোনো জবাব দিতে পারেননি। এসময় সভাপতি বলেছেন, মানুষের যে ভোগান্তি, এই ভোগান্তিতে আমরা সবার কাছে বেইজ্জতি হলাম। মানুষ তো সরকারকে গালি দেয়। এটা নিয়ে আরও সর্তক হওয়ার পরামর্শ দেন সভাপতি।

বৈঠকে সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই কথা বলবে। এনিয়ে উপস্থিত সকলেই সায় দেন। সভাপতি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে অন্য কেউ কথা বলবে না। অন্যরা পরামর্শ দিতে পারে কিন্তু অন্যরা মন্ত্রণালয় চালাতে পারে না।’

বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো ওনার মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে অন্যরা কথা বলায় বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে এবিষয়ে মন্ত্রী একটু অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।

গত ১০ম বৈঠকের কার্যপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেখা গেছে বৈঠকে উপস্থিত সকল সদস্যই ক্ষুব্ধ ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রতি। যদিও গত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী। তাই ১১তম বৈঠকে মন্ত্রীকে পেয়ে পূর্বের কথাগুলো রিপিট করেন সকলে।

কমিটি সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘৫০ ভাগ করে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন আমদানি করার কথা থাকলেও সেখানে সফলতা অর্জিত হয়নি। গোপালগঞ্জ জেলায় সরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইডিসিএল থাকা সত্ত্বেও প্রাইভেট সেক্টরে ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে কেন? ভ্যাকসিন আসার পূর্বেই ঘোষণা করা হয় যে ৭ কোটি ভ্যাকসিন আসছে এবং পরবর্তীতে দেখা যায় যে সেটা আসেনি এভাবে কিছু অযৌক্তিক তথ্য প্রদানের কারণে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে যা সরকারের জন্য বিব্রতকর।

সভাপতি আরও বলেন, যে সকল মানুষদের ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য রেজিস্ট্রেশন করা হলো তাদের ভ্যাকসিন না দিয়ে গ্রামে গিয়ে গণ টিকা প্রদানের ঘোষণা করা হলো, আবার বলা হয় যে আইডি কার্ড প্রদর্শন করা হলেই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে। এটা কেন? তিনি আমদানি অনুযায়ী যত সংখ্যক লোককে টিকা দেওয়া সম্ভব তা সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা মাধ্যমে জনগণকে অবহিত করার জন্য পরামর্শ দেন।

সভাপতি বলেন, বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হলে করোনা পরিস্থিতির সঠিক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব। আগে সংখ্যা নির্ণয় করে করোনা টিকা দেয়ার ঘোষণা সরকারের জন্য বিব্রতকর বলে উল্লেখ করেন তিনি। হাজার হাজার মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন, ভ্যাকসিন সম্পর্কিত এ ধরনের ভুল তথ্য জনগণকে প্রদান না করার পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া যারা রেজিস্ট্রেশন করেছে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন প্রদানের পরামর্শ দেন।

কমিটির সদস্য সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, কি পরিমাণ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে সে তথ্যটি গ্রামগঞ্জের মানুষের কাছে যথা সময়ে পৌঁছে না। কোন এলাকায় কত সংখ্যক লোককে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে সে বিষয়টি নিশ্চিত করে মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে অবহিত করার অনুরোধ জানান।এছাড়া সকল প্রকার বিভ্রান্তি দূর করার স্বার্থে দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রী বা একজন কর্মকর্তা দ্বারা করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে নিয়মিত ব্রিফ করার বিষয়টি নিশ্চিত করার অনুরোধ জানান।

কমিটি সদস্য ডা. আব্দুল আজিজ বলেন, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মর্ডানা গ্রাম অঞ্চলের সিনোফার্মের টিকা কেন দেওয়া হল সে বিষয়টি পরিস্কার ভাবে মানুষকে অবগত না করার কারণে যারা সরকারের বিরোধিতা করছেন তারা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে শহরের মানুষকে ভাল ভ্যাকসিন দিচ্ছে আর গ্রামের মানুষকে খারাপ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকার দরকার ছিল। তাছাড়া পূর্ব থেকে সংখ্যা নির্ণয় না করেই গণটিকার ঘোষণা প্রদান সরকারের জন্য বিব্রতকর বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন বাচ্চারা ঘরে বসে থাকার কারণে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই মানসিক অবসাদ রোগে ভুগছেন। তিনি দেশের শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ১২ বছর বয়সের স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার সুপারিশ করেন।

মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ের মানুষ ভ্যাকসিন পাচ্ছে না, বিধায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য নির্দিষ্ট একজন মুখপাত্র মাধ্যমে মিডিয়ায় ব্রিফিং প্রদানের সুপারিশ করেন।

কমিটি সদস্য সৈয়দা জাকিয়া নূর বলেন, ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই কতজনকে কত দিনের মধ্যে ভেকসিন প্রদান করা হবে সে বিষয়টি তিনি কমিটিকে অবহিত করার অনুরোধ করেন। এছাড়া বর্তমানে করোনার পরিস্থিতি কি তা জানতে চান। লকডাউন বিভিন্ন নামে নামকরণ করায় মানুষের মাঝে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য লকডাউনকে একটি বিশেষ নামে অবহিত করার অনুরোধ জানান।

এসব বক্তব্যের জবাবে সেদিন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব (স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ) বলেছিলেন, পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন আমদানির লক্ষে জি-টু-জি পদ্ধতিতে বিশ্বের সকল ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী দেশের সাথে চুক্তি হয়েছে। স্পুটনিক' ভি আমদানির ব্যাপারে রাশিয়ায় চূড়ান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। তাছাড়া দেশে এ পর্যন্ত মোট ৩ কোটি ১০ লাখ ১৫ হাজার ৫১০ ডোজ ভ্যাকসিন আমদানি করা হয়েছে, যার খরচ হয়েছে ২ কোটি ৪ লাখ ৯ হাজার ৯১০ ডোজ। আর এখন হাতে আছে ১ কোটি ১ লাখ ২৫ হাজার ১০ ডোজ। অন্যদিকে বিভিন্ন কোম্পানির নামে যে ভ্যাকসিন আসছে তার গুণগতমানের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বলে জানান সচিব।

কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম এর সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক, আ.ফ.ম. রুহুল হক, মুহিবুর রহমান মানিক, মো. মনসুর রহমান, মো. আব্দুল আজিজ, সৈয়দা জাকিয়া নুর, রাহগির আলমাহি এরশাদ এবং মো. আমিরুল আলম মিলন বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন।

বৈঠকে ‘বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট বিল, ২০২১’ এবং ই.ডি.সি.এল গোপালগঞ্জ শাখা কর্তৃক কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

‘বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট বিল, ২০২১’ প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ জাতীয় সংসদে উত্থাপনের সুপারিশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর