তীর-ধনুক চালানোয় পারদর্শী ওরা

, জাতীয়

তোফায়েল হোসেন জাকির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গাইবান্ধা | 2023-08-29 21:21:50

এরা সেই আদি যুগের এনালগ শিকারি। আজও পরিবর্তন হয়নি জীবনমান। পূর্বপুরুষদের সেই দলবদ্ধ ভাবে একত্রিত হয়ে বসবাস করার নিয়মটা এখনো ধরে রেখেছে এই সাঁওতাল সম্প্রদায়। এরা অন্যান্য জাতি-গোত্রের তুলনায় অনেকটাই বেশি একতাবদ্ধ ভাবে বসবাস করে।

সোমবার (২৯ আগস্ট) বিকালে এই সম্প্রদায়ের ২২ সদস্যের একটি দলের সঙ্গে দেখা মেলে গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার ধাপেরহাট এলাকায়। এদের সবার বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জের চতরাহাট এলাকার অনন্তপুর গ্রামে। হেঁটে ১৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এসেছে শিকারের সন্ধানে।

জানা যায়, সাঁওতালের এই দলটি শিকারের সন্ধানে চলেছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ঝোঁপ-ঝাড়ে, জঙ্গলে যেখানে রয়েছে শিকারের আনাগোনা। সারাদিন শিকার খুঁজে পেয়েছে মাত্র একটি গারোয়া বা বন বিড়াল নামক প্রাণী। যার ওজন ৭/৮ কেজি। এদের কারো হাতে তীর-ধনুক, কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে বল্লম (শুলপি)। সঙ্গে রয়েছে দুটি পোষা কুকুর।

কথা হয় এ দলের সদস্য রাম্পা, রঘুনাথ, টুডু, আর বিশ্বনাথ মুরমুর সঙ্গে। তাদের ভাষায় তারা বলেন, বাবু আমাদের আর পোষায় না। আগের মতো বন-জঙ্গল নেই। তাই শিকারের দেখা পাওয়া যায় না। যদিও দুই-একটি কপাল গুণে দেখা মেলে, এতোগুলি লোক নিয়ে তা ধরে পোষায় না। তাই আমরা এখন অনেকেই পরের জমিতে কৃষিকাজ করি। কাজকর্ম না থাকলে শখের বসে দলবদ্ধ হয়ে শিকারের সন্ধানে বের হই। আর মহিলারা বাঁশঝাড়, বন-জঙ্গলে মাটির নিচ থেকে আলু তুলে (বিষ আলু)। এসব খেয়ে পরেই পরিবার পরিজন নিয়ে কোনমতে বেঁচে আছি। তবে বাবু, এখন আমরা কিছু কিছু সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি। আমরা এখন ভোটাধিকার পেয়েছি। মেম্বার-চেয়ারম্যান-এমপি নির্বাচনে ভোট দিতে পারি। সব মিলে বেঁচে আছি।

শিকার ধরার কৌশলাদি জানতে চাইলে তারা বলেন, আমাদের চোখ আর তীরের নিশানা মিস হয় না। প্রথমে শিকারকে লক্ষ্য করে হাতের তীর ছুড়ে মারি। এতে শিকার গর্তে ঢুকে গেলে শাবল দিয়ে মাটি খুড়ে লাঠি দিয়ে আঘাত করে শিকারকে আহত করি। আর যদি শিকার দৌড়ে পালাতে চায় তাহলে আমাদের সাথে থাকা পোষা কুকুরকে লেলিয়ে দেই।

শিকার বলতে- গারোয়া বন বিড়াল, বড় ইঁদুর, কাঠ বিড়ালি, বেজি, কুচিয়া মাছ, খরগোশ আরও অন্যান্য প্রাণি।

এই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্য হেমাংকু বলেন, মোবাইলের যুগ, অনেকে আমাদের ফোন নম্বর নিয়েছে। এখন তারা ফোন করে খবর দেয় তাদের বাড়ির পাশে বাঁশ ঝাড়, জঙ্গলে, গারোয়ার উৎপাত বেড়েছে। প্রায়ই গৃহপালিত প্রাণি হাঁস, মুরগি, কবুতর খেয়ে সাবার করছে। আসেন ভাই, মারেন। তাই বাধ্য হয়েই আমরা ছুটে যাই। বন্যপ্রাণী মারা অন্যায় এমন প্রশ্ন করতেই উত্তর দেয় আমরাতো বড় কোন প্রাণীর ক্ষতি করছি না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য বা অনেক সময় পেটের দায়েই শিকার করে থাকি। অনুষ্ঠান বলতে ২৫ ডিসেম্বর বড় দিন, বিবাহ অনুষ্ঠানের আগে আমরা বিভিন্ন প্রাণী শিকার করে থাকি। এছাড়াও পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা দলবদ্ধ ভাবে শিকারের সন্ধানে বেড় হই। সারা দিনে একটি মাত্র শিকার, তাও আবার ২২ জন মিলে ভাগ-বাটোয়ারা হবে কেমনে?

উল্লেখ্য, দেশ স্বাধীনের সময় সাঁওতালরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ এই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তীর-ধনুক পরিচালনায় পারদর্শী বেশ কিছু যুবক রংপুর পাক সেনাদের ক্যাম্প আক্রমণ করেছিল। যা রংপুরের প্রবেশদ্বার মর্ডান মোড়ে মুক্তিযোদ্ধা ফলকে আজও দৃশ্যমান। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন হলেও উন্নয়ন হয়নি এই সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর