লক্ষ্মীপুরের ঐতিহ্যের ধারা পান চাষ ও খাওয়া

, জাতীয়

মীর ফরহাদ হোসেন সুমন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, লক্ষ্মীপুর | 2023-08-31 20:10:27

আবহমান কাল ধরে লক্ষ্মীপুরের জনপদে প্রচলিত একটি কথা 'পানেই মান'। চরাঞ্চল অধ্যুষিত মেঘনা উপকূলীয় এ জেলার সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে পান। এখানকার যেকোন বাড়িতে ছোট-বড় যে কোন অনুষ্ঠান অথবা পারিবারিক আতিথ্যেয়তা শেষে পান পরিবেশন করা ঐতিহ্যের অংশ। পরিবারে হঠাৎ আগন্তুক কোন মেহমানকে দেওয়ার মতো আর কিছু না থাকলে অন্তত সুন্দর পরিবেশনায় এক-দুই ফালি পান দেওয়া চাই। বিশেষ করে নতুন বর শ্বশুর বাড়ি আসা যাওয়ার সময় আর সব কিছুর সাথে পান থাকাটা এখানে অনেকটা বাধ্যবাধকতার বিরাজমান সংস্কৃতি।

পাত্রী দেখা অনুষ্ঠানে মিষ্টি-সন্দেষের সাথে পান না নিলে প্রথম দফায় নাখোষ হয় পাত্রীপক্ষ। এছাড়া বিকেল কিংবা রাতে প্রতিবেশী কয়েক পরিবারের রমনীদের আড্ডায় বাটাসহ পানের সরবরাহ থাকা লাগবেই। আর হাটে-বাজারে কথায় কথায় বয়স্ক বন্ধুরা নিজেদের ভেতর পান দেয়া নেয়া নৈমিত্তিক বিষয়। পানের সাথে যেন মানসম্মান বিষয়ক সম্পর্কের মিশেল রয়েছে লক্ষ্মীপুরের জনজীবনে। তাই পানকে কেন্দ্র করে নানান প্রবাদ কথা,গান,গীতি কাব্য মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে এ জেলায়।

এগুলোর মধ্যে অধিক প্রচলিত একটি কথা 'পানেই মান'। তাই হয়তো যুগ যুগ ধরে লক্ষ্মীপুর জেলা জুড়ে পান চাষ বহমান ঐতিহ্যের আরেক ধারা।

অপরদিকে যুগের বিবর্তনে বর্তমানে পান চাষ এখানে অনেক লাভজনকও বটে। তাই পান চাষের সু-উপযোগী এ জেলায় দিন দিন বাড়ছে পরকল্পিত পানের চাষ। লাভজনক হওয়ায় বর্তমানে পান চাষে শিক্ষিত বেকারদের অনেকেরও আগ্রহ বেড়ে চলেছে। লক্ষ্মীপুর জেলাজুড়ে বেশকিছু গ্রামের মাঠে নিজ মেধা ও উদ্যোগে পান চাষ করে ব্যাপক সফলতা পাচ্ছেন কৃষকরা। আর আয় করছেন লাখ লাখ টাকা।

পরিস্থিতির আলোকে এখন এ জনপদের পান বিষয়ক প্রচলিত কথায় নতুন কথা যোগ হয়ে হতে পারে 'পানেই মান,পানেই ধন'।

জেলা কৃষি বিভাগ এর তথ্যমতে চলতি বছর লক্ষ্মীপুরে প্রায় ৩ হাজার ৬ শত মেট্রিক টন পান উৎপাদন হয়েছে। এবার উৎপাদিত পান থেকে প্রায় ৭০ কোটি টাকা আয় হবে বলে জানায় কৃষি সম্প্রাসরণ অধিদপ্তর। তবে জেলায় কোন সংরক্ষণাগার না থাকায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয় পান চাষীদের।

স্থানীয়দের দাবি, প্রয়োজনীয় ঋন সুবিধা ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লক্ষ্মীপুরের উৎপাদিত পান রপ্তানি করে জাতীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখা সম্ভব।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একর প্রতি পানের বরজে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ করে পরবর্তী বছর থেকে প্রতি বছর লাভ করা যায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা।  প্রতিবিঘা জমির পানের বরজে মাটির আইল, বেড়া, ছাউনি, শ্রমিক, পানের লতাসহ ১ থেকে দেড় লাখ টাকা প্রাথমিক অবস্থায় খরচ হয়। পরের বছর থেকে খরচ খুবই সামান্য হয়। কারণ একটি পানের বরজ তৈরি করার পর মাটির আইল, বেড়া, ছাউনি সংস্কার ছাড়া ৪০-৪৫ বছর পর্যন্ত পানের বরজ অক্ষুন্ন থাকে। সেখান থেকে পান পাওয়া যায়। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত পানের ভরা মৌসুম। ভাদ্র থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত পানের উৎপাদন কম হয়। ফাল্গুন মাসে বাড়ন্ত লতিকে নিচে নামিয়ে দেওয়াতে পানের উৎপাদন হয় না বললেই চলে। এছাড়া তারা আরও জানায়, উৎপাদন খরচের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ লাভ হওয়ায় পান চাষের দিকে ঝুঁকছেন অধিকাংশ কৃষক। তবে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে  অনেকে আবার পানের বরজের প্রসার ঘটাতে পারছেন না বলেও জানায় কৃষকরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, চলতি বছর লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলায় প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় প্রায় আড়াই হাজার বরজে পান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে রায়পুর উপজেলায় ৪০০ হেক্টর জমিতে প্রায় এক হাজার ৬২০টি বরজে পান চাষ করেন কৃষক। এবছর প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১৫-১৬ হাজার বিড়া (৭২টি পানে এক বিড়া) পান উৎপাদন হয়েছে। স্থানীয় বাজারগুলো থেকে পাইকাররা এক পাই (১২ বিড়া), এক কুড়ি (৪৮ বিড়া) ও এক গাদি (১৯২ বিড়া) হিসেবে আকারভেদে ক্রয় করছেন। বর্তমানে প্রতি বিড়া পান আকারভেদে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়,জেলার রায়পুর উপজেলায় সবচেয়ে বড় পানের পাইকারি বাজার বসে। সপ্তাহের সোমবার এবং শুক্রবার রায়পুর বাজার, শনি এবং বুধবার হায়দারগঞ্জ বাজার, রবি-বৃহস্পতিবার ক্যাম্পেরহাট বাজারে বসে পানের বড় বাজার। ব্যবসায়ীগণ এখান থেকে পান ক্রয় করে ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পানের চাহিদার যোগান দিচ্ছেন।

রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী গ্রামের পানচাষি জাকির হোসেন জানান, প্রথম বছর ২০ শতাংশ জমিতে পান চাষ শুরু করি। ওই বছর ১ লাখ টাকা লাভ হয়। পরে আরও ২৬ শতাংশ জমি নিয়ে মোট ৪৬ শতাংশ জমিতে পান চাষ শুরু করি। এখন বছরে লাভ হয় ৪-৫ লাখ টাকা।

কামাল হোসেন নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারি আরেকজন চাষী জানান, বাংলাদেশে ভালো কোনো চাকরী যেন সোনর হরিণ। দীর্ঘদিন চাকরীর খোঁজ করে চাকরী না পাওয়ায় বাবার সাথে পানের বরজে সময় দেন। বর্তমানে তার ৫০ শতক জমিতে পানের বরজ রয়েছে। গত চার বছরে এ বরজ তৈরি ও আবাদ করতে তার ২ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। এখন পর্যন্ত কামাল হোসেন প্রায় ৭-৮ লাখ টাকার বেশি পান বিক্রি করেছেন বলে জানান।

রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন জানান, এখানকার উৎপাদিত পান সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা ও দাম বেশি। পান চাষকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লক্ষ্মীপুরের উপ-পরিচালক বেলাল হোসেন খাঁন জানান, পান চাষে রোগবালাই ও ঝুঁকি কম থাকায় স্থানীয় কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন এ অঞ্চলে পান চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর