প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ শিকার বন্ধ রাখতে ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারাদেশের নদ-নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। মাছ শিকারের এ নিষিদ্ধ সময়ে কুড়িগ্রামের তালিকাভুক্ত ইলিশ জেলেদের মধ্যে দুস্থ ও প্রকৃত মৎস্যজীবীদের মানবিক সহায়তা হিসেবে এবছরও ১৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ এবং মৎস্য বিভাগের নিজস্ব কোনও নৌকা ও জনবল না থাকায় নদীকে জালমুক্ত রাখতে অভিযান পরিচালনা ও সফলতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অভিযানে ভাড়া নৌকাই একমাত্র ভরসা বলে জানিয়েছে মৎস্য বিভাগ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলায় ১৬টিরও বেশি নদ-নদী থাকলেও মূলত ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদে ইলিশের বিচরণ ঘটে। এসব নদ-নদী অববাহিকার জেলা সদর, নাগেশ্বরী, উলিপুর, চিলমারী ও রাজীবপুর উপজেলার ১২ হাজার ৬৫৭ জন তালিকাভুক্ত জেলের মধ্যে সাড়ে ৭ হাজার ইলিশ জেলের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ) প্রকল্পের আওতায় ২০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে সদরে সর্বাধিক ২ হাজার ৭২৫ এবং উলিপুরে ২ হাজার ৫২০ জন জেলে এই প্রণোদনা পাবেন। শিগগিরই এই চাল তালিকাভুক্ত জেলেদের মাঝে বন্টন করা হবে। এই প্রণোদনা জেলেদের ইলিশ শিকার থেকে বিরত রাখতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছে মৎস্য বিভাগ।
ইলিশ শিকারে নিষিদ্ধ সময়ে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) কালিপদ রায় জানান, ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সময় সরকার সারাদেশের নদ-নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি এ সময় দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, বিপণন, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময় এবং মজুতও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষায় সরকার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে হাট বাজারে ব্যানার লাগানোসহ সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে গুচ্ছ মিটিং শুরু হয়েছে। জেলেদের সঙ্গে মত বিনিময় করা হচ্ছে। এছাড়াও সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করতে জেলাজুড়ে মাইকিং এর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সাগর থেকে কুড়িগ্রামের জলসীমায় ইলিশ মাঝ পৌঁছাতে কিছুটা বিলম্ব ঘটে জানিয়ে ডিএফও বলেন,‘ বাধামুক্ত পথে সাধারণত ইলিশ মাছ এক দিনে ৩০ কিলোমিটার পথ পারি দিতে পারে। সে অনুযায়ী কুড়িগ্রামের জলসীমায় পৌঁছাতে ১২ থেকে ১৪ দিনের মত সময় লেগে যায়। এরপরই জেলার নদ-নদীতে ইলিশের দেখা মেলে।’
তবে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ ও জনবল সংকটে ইলিশ শিকারের নিষিদ্ধ সময়ে ২২ দিন নদীতে অভিযান পরিচালনা ও এর সফলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে মৎস্য বিভাগ। দীর্ঘ জলসীমা মৎস্য শিকার মুক্ত রাখতে হিমশিম খেতে হয় বলে জানিয়েছেন মৎস্য কর্মকর্তারা।
ডিএফও কালিপদ রায় জানান, এবছর জেলার ৫ উপজেলার নদ-নদীকে ইলিশ জোনের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। এসব উপজেলায় ২২ দিনের অভিযান ও প্রচারণার জন্য ৩৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে প্রতি উপজেলায় গড়ে ৭ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
ডিএফও বলেন, ‘এই বরাদ্দ অপ্রতুল। আমাদের নিজন্ব কোনও নৌযান নেই। এক দিনের অভিযানেই নৌকা ভাড়া দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। এছাড়াও জনবল খরচ রয়েছে। সেখানে এই বরাদ্দ দিয়ে ২২ দিন অভিযান পরিচালনা কীভাবে সম্ভব? তবুও আমরা সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠে কাজ করছি।’
জেলার সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোর মৎস্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশ শিকারের নিষিদ্ধ সময়ে নদ-নদীতে অভিযান পরিচালনার জন্য যে বরাদ্দ পাওয়া যায় তা দিয়ে নদীতে অভিযানের এক দুই দিনের অভিযানের খরচ মেটে। অভিযানের শিথিলতায় জেলার নদীগুলো জালমুক্ত রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ফলে জলসীমার বেশ কিছু অংশে মাছ শিকার বন্ধ করা সম্ভব হয় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইলিশ জোনভুক্ত উপজেলাগুলোর কয়েকজন মৎস্য কর্মকর্তা জানান, মৎস্য বিভাগের নিজস্ব কোনও নৌকা নেই। ভাড়া নৌকায় একদিন অভিযান পরিচালনা করতেই প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়। অভিযানের জন্য যে বরাদ্দ পাওয়া যায় তা দিয়ে ২২ দিন অভিযান পরিচালনা করা মোটেও সম্ভব নয়।
ডিএফও কালিপদ রায় বলেন, ‘সরকারি আদেশ বাস্তবায়ন করতে প্রচারণা পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে নদীতে অভিযান পরিচালনা করা হবে। জেলা মৎস্য বিভাগ সে প্রস্তুতি নিয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে কুড়িগ্রাম জেলাকে ইলিশ জোনভুক্ত করা হয়। এরপর ২০১৯ সাল থেকে ইলিশ ধরার নিষিদ্ধ সময়ে জেলার ইলিশ জেলেদের জন্য প্রণোদনা বরাদ্দ দেয় সরকার। জেলার প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার নিবন্ধিত জেলে থাকলেও খাদ্য সহায়তা হিসেবে ২০ কেজি করে চাল পাচ্ছেন শুধু ইলিশ জেলেরা। এছাড়াও খাদ্য সহায়তার বাইরে থাকছেন প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি জেলে পরিবার। এই বিপুল পরিমাণ জেলে পরিবারকে প্রণোদনার বাইরে রেখে নদীতে মাছ ধরা শতভাগ বন্ধ রাখা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন জেলে নেতারা। এ পরিস্থিতিতে অন্তত নদীতে মাছ আহরণের ওপর নির্ভরশীল জেলে পরিবারগুলোকে প্রণোদনা হিসেবে চাল ও অর্থ সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে মাছ আহরণে বিরত রাখতে পারলে ইলিশ প্রজননে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।