দিন বদল হয়নি নরসুন্দর কালামের

ময়মনসিংহ, জাতীয়

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, ডিস্ট্রিক করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 15:30:23

বড়সড় আমগাছটার বুকে দুটো পেরেক গাঁথা। পেরেকে সুতো বেঁধে টানানো হয়েছে ভাঙা আয়না। তার বিপরীতে পাতা একটি কাঠের চেয়ারে বসে এক ব্যক্তি তাকিয়ে আছেন আয়নায়। আর মাঝ বয়সী এক যুবক হাতে চিরুনি ও কাঁচি নিয়ে সেই ব্যক্তির চুল কেটে যাচ্ছেন একমনে।

এক সময়কার গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ চিত্র ছিল এটি। কিন্তু আধুনিক যুগের সেলুন অথবা জেন্টস পার্লারের দাপটে খোলা আকাশের নিচে নরসুন্দরদের ক্ষৌরকর্মের এই দৃশ্য এখন অনেকটাই বিরল। তবে ময়মনসিংহের গৌরীপুর রেলওয়ে জংশনে রোববার (৪ নভেম্বর) এমন একটি দৃশ্য চোখে পড়ে।

কাছে গিয়ে কথা হয় ওই নরসুন্দরের সঙ্গে। এ প্রতিনিধিকে তিনি জানান তার নাম মো. কালাম (৩৫)। বাড়ি রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন চকপাড়া মহল্লায়। বাবার নাম আব্দুল হাকিম। মায়ের নাম ফাতেমা খাতুন। তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। আগে অভাব-অনটনের কারণে তিনবেলা পেটে ভাত জুটত না। তাই জীবিকার তাগিদে বাবার সূত্র ধরে এই পেশায় এসেছেন তিনি।

কথা বলতে বলতেই এক ট্রেনযাত্রীর চুল কেটে চলেছেন কালাম। নিপুণ হাতে চিরুনি ও কাঁচিতে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং শব্দ তুলে কাজটি করছেন খুব সহজ ভাবে। চুল কাটা শেষে শেভ করার প্রস্তুতি নিতেই স্টেশনে প্রবেশ করল ভৈরবগামী একটি ট্রেন। তাই শেভ না করে কালামের হাতে টাকা দিয়ে ওই লোক উঠে পড়ল ট্রেনে। মুচকি হেসে কালাম বলে উঠেন-‘বুঝলেন ভাই আমার কিছু কাস্টমারই থাকে দৌড়ের ওপরে।’

এরই মধ্যে মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় কালো হয়ে গেছে চারদিক। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে স্টেশনে। গা বাঁচাতে অপেক্ষমান ট্রেন যাত্রীরাও ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু ক্ষৌরকর্মের সামগ্রী পুঁটলিতে ভরে কালাম দাঁড়িয়ে আছে আমগাছটার নিচেই। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এ প্রতিনিধির সঙ্গে জীবনের গল্প জুড়ে দেয় কালাম।

তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় পড়াশোনা করার জন্য বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। কিন্তু আমি স্কুলে না গিয়ে খেলাধুলা করে বাড়ি ফিরতাম। তখন বাবা আক্ষেপ করে বলতেন, ‘গোলামের পুত পড়ালেহা না করলে খাইবি কী? আমার তো জমি-বাড়ি কিছুই নাই যে বেইচ্যা বেইচ্যা খাইবি। আমার লগে থাইক্যা এই কামডা শিইখ্যা রাখ। একটা কিছু কইর‌্যা তো তোর খাওন লাগবো।’ এরপর বাবার সঙ্গে থেকে ক্ষুর-কাঁচির কাজটা রপ্ত করে ফেলি।’

কথা প্রসঙ্গে কালাম বলেন, ‘বার্ধক্যজনিত রোগে বাবা বিছানায় পড়েছে বহু বছর আগে। কিন্তু জীবিকার তাগিদে আমি এই পেশা নিয়ে স্টেশনে পড়ে আছি গত একযুগ ধরে। ইতোমধ্যে আমিসহ দুই ভাই জুয়েল, সোহেল ও তিন বোন হাসিনা, মৌসুমী ও খালেদা বিয়ে করে আলাদা হয়েছি। তবে বাবা, মা ও স্কুল পড়ুয়া ছোট ভাই সোহেল রয়ে গেছে আমার সংসারেই। কিন্তু সংসারের হাল ধরতে এখনো বৃদ্ধ মাকে কাজ করতে হয় পরের বাড়িতে।’

সময়ের বিবর্তনে গত একযুগে স্টেশনে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। আন্তনগর ট্রেন চালুর পাশাপাশি গড়ে উঠছে স্টেশনের নতুন ভবন। কিন্তু দিন বদল হয়নি নরসুন্দর কালামের। রোদ ও ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্টেশনের আমগাছ তলায় ক্ষৌরকর্মের কাজ করেন কালাম। পোশাক শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, রিকশা চালক, দিনমজুর, ট্রেনযাত্রীসহ নিম্ন আয়ের লোকজন তার কাস্টমার। তার এখানে চুল কাটা ২৫ টাকা, দাড়ি শেভ ১০ টাকা। সারাদিন তার কাজ করে আয় হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এই টাকায় চলে তার সংসার, বাবার চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচ।

দাম্পত্য জীবনে কালামের জয় নামে এক ছেলে আছে। অভাবের কারণে তিনি ছেলেকে ভালো স্কুলে ভর্তি করতে পারেননি। ছেলেটি এখন স্থানীয় হাফেজি মাদরাসায় পড়ছে। কিন্তু সেখানেও আছে স্বপ্ন ভাঙার শঙ্কা। কিন্তু কালাম অনড়। যেভাবেই হোক ছেলেকে তিনি মানুষ করবেন।

কালাম বলেন, ‘ছোটবেলায় স্কুল ফাঁকি দিয়েছি। পড়ালেখা করিনি। তাই আমাকে নাপিত হতে হয়েছে। আমি চাইনা ছেলে এই পেশায় আসুক।’

এরই মাঝে বৃষ্টি থেমে গেছে। চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা আন্তনগর ট্রেন বিজয় এক্সপ্রেস প্রবেশ করেছে স্টেশনে। এক বৃদ্ধ লোক তড়িঘড়ি করে গাছতলায় পাতা চেয়ায়টায় বসে বলে উঠেন- ‘ওই মিয়া তাড়াতাড়ি দাড়িডি শেভ কইর‌্যা দেও। ট্রেন ছাইর‌্যা দিব।’ দ্রুত পুঁটলিতে রাখা চাদর বের করে বৃদ্ধের শরীরে মুড়ে দেয় কালাম। মুখে শেভিং ক্রিম মেখে ক্ষুর টান দিতেই কালামকে বাঁধা দিয়ে বৃদ্ধ বলেন, ‘আরে মিয়া ক্ষুরের পুরান ব্লেডটা বদলাইয়া লও।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর