দেশের প্রথম রেলস্টেশন ‘জগতি স্টেশন’

খুলনা, জাতীয়

এস এম জামাল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 20:04:20

দেশের প্রথম রেলস্টেশন হচ্ছে কুষ্টিয়ার ‘জগতি স্টেশন’। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ঔপনিবেশিক বাংলায় রেলওয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও পণ্য পরিবহনের কাজে এ অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে স্টেশনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট থেকে কুষ্টিয়ার দর্শনা ও পোড়াদহ হয়ে জগতি পর্যন্ত ব্রডগেজ এই রেলপথের উদ্বোধন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জগতি স্টেশনটি। তখন জ্বালানি হিসেবে ‘কয়লা’ পুড়িয়ে সাদা-কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে ঝিকঝিক শব্দে স্টিম ইঞ্জিনের (বাষ্পচালিত) রেলগাড়ি এসে থামত স্টেশনে।

রেলগাড়ি দেখতে আশপাশের কৌতূহলী মানুষজনের ভিড় জমত। পণ্য পরিবহনসহ যাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল এই রেলস্টেশনটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে পুরনো স্টেশনটি আজ তার জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছে।

অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে স্টেশনের লাল রঙের দ্বিতল ভবনের ছাদ জুড়ে জন্মেছে পরগাছা। ফটল ধরেছে তার সারা শরীরে। স্টেশনটি বর্তমানে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া স্টেশনের কয়েকশ বিঘা জমি অবৈধ দখলে চলে গেছে। এসব দেখভাল করার যেন কেউ নেই।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জর্জ স্টিফেনসনের আবিষ্কৃত বিশ্বের প্রথম স্টিম ইঞ্জিনের রেল উদ্বোধন করা হয়। ‘লোকোমোশান’ নামের ওই ট্রেনটি ব্রিটেনের স্টকটন থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে ডালিংটন পর্যন্ত যায়। প্রথম এই রেল ইঞ্জিনের প্রথম চালক ছিলেন রেলের আবিষ্কারক সিভিল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার জর্জ স্টিফেনসন নিজেই। ওই সময় ক্রমান্বয়ে বিশ্বজুড়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেলওয়ের বিপ্লব শুরু হয়। রেলের এই অগ্রগতিতে ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলাও পিছিয়ে ছিল না।

রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও কৌশলগত সুবিধাসহ বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনায় ব্রিটিশ সরকার ঔপনিবেশিক বাংলায় রেলওয়ে স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পর্যায়ে ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল গেট ইন্ডিয়ার পেনিনসুলার রেলওয়ে নামক কোম্পানির নির্মিত মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের উদ্বোধন করা হয়। এটিই ছিল ব্রিটিশ ভারতে রেলওয়ের প্রথম যাত্রা।

অপরদিকে ১৮৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে বাংলায় প্রথম রেলপথ চালু করা হয়।

এরপর বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে রেললাইন স্থাপনের বিষয়টিও ব্রিটিশ সরকার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়। ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃক কলকাতার শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করা হয়। পরে এই লাইনকে বর্ধিত করা হয়। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার (সাবেক নদীয়া) দর্শনা থেকে পোড়াদহ হয়ে জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রডগেজ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে প্রথম রেল যোগযোগ স্থাপিত হয়।

পরে ঢাকার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করতে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি জগতি স্টেশন থেকে বর্তমান রাজবাড়ী জেলার পদ্মা তীরবর্তী গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত রেললাইন চালু করা হয়।

এ সময় মানুষ কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে জগতি স্টেশন হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে নামতেন এবং স্টিমারে পদ্মানদী পার হয়ে চলে যেতেন ঢাকায়।

ব্রিটিশ সরকার জগতি রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু অবকাঠামো গড়ে তোলা হয় এখানে। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেগুলো আজ শুধুই স্মৃতি হয়ে রয়েছে। স্টেশনের ওয়েটিং রুম ভেঙে পড়েছে। প্লাটফর্মে ইট ও গাঁথুনি ক্ষয়ে গেছে। সংস্কারবিহীন স্টেশনের দ্বিতল ভবনের ছাদে জন্মেছে আগাছা। রেলের স্টিম ইঞ্জিনে পানি খাওয়ানোর জন্য প্লাটফর্মের দুই পাশে নির্মিত বিশাল আয়তনের ওভারহেড পানির ট্যাংক দুটি ইতোমধ্যে পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। ট্যাংক দুটিতে সে সময় কয়লার ইঞ্জিনচালিত পাম্প দিয়ে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করা হতো।

স্বাধীনতার পূর্বে কুষ্টিয়ায় চিনিকল প্রতিষ্ঠার পর এখানে আখ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই স্টেশনের। তখন আশপাশের জেলার জন্য ট্রেনে আনা খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী খালাস ও যাত্রী ওঠা-নামা করত এই স্টেশনে। অথচ জগতি স্টেশনটি আজ কোলাহল মুক্ত নীরব নিথর। বর্তমানে এখানে যাত্রীসেবামূলক কিছুই নেই। চারদিকে বিরাজ করে নির্জন এক ভুতুড়ে পরিবেশ। স্টপেজ না থাকায় বর্তমানে এই স্টেশনের ওপর দিয়ে চলে যায় রাজশাহী-গোয়ালন্দঘাটগামী আন্তনগর ট্রেন মধুমতি এক্সপ্রেস।

এখানে শুধুমাত্র স্টপেজ রয়েছে সরকারের লিজ দেয়া খুলনা-গোয়ালন্দঘাট মেইল ট্রেন নকশিকাঁথা এক্সপ্রেস এবং পোড়াদহ ও রাজবাড়ির মধ্যে চলাচলকারী শাটল ট্রেনের। এই দুটি ট্রেনের অল্পসংখ্যক যাত্রী ওঠা-নামা করে।

তবে স্টেশনে যাত্রীসেবা না থাকায় তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জনবলের অভাবও রয়েছে প্রকট। বর্তমানে এই স্টশনে স্টাফ রয়েছে মাত্র পাঁচজন। এদের মধ্যে ১ জন স্টেশন মাস্টার, ৩ জন পয়েন্সম্যান ও ১ জন গেটম্যান।

অপরদিকে ২ জন স্টেশন মাস্টার, ৩ জন বুকিং সহকারী, ৩ জন ল্যামম্যান, ৩ জন পয়েন্সম্যান ও ২ জন সুইপারের পদ দীর্ঘদিন থেকে শূন্য রয়েছে।

নিরাপত্তা কর্মী না থাকায় লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত পিনসহ রেলের মূল্যবান সম্পদ খোয়া যাচ্ছে বলে জানান রেলওয়ে কর্মচারীরা।

রেলওয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠার সময় জগতি স্টেশনের আওতায় রেলের অন্তত ৭শ বিঘা জমি ছিল। কিন্তু এসব জমির অধিকাংশই এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে। এসব জমি উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই।

এদিকে কালের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা ঐতিহ্যের ধারক দেশের প্রথম এই স্টেশনটি আধুনিকায়ন না হওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় আধুনিকায়নসহ স্টেশনটির হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা হোক।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও জগতি গ্রামের বাসিন্দা শিমুল বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমাদের এই জগতিতে অবস্থিত দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশনটির এ বেহালদশা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আগের সেই হারানো সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনাসহ স্টেশনটি আধুনিকায়ন করে যাত্রী সেবার মান উন্নয়নের দাবি জানাচ্ছি।’

জগতি স্টেশন মাস্টার মুসলিম উদ্দিন মোল্লা বার্তা২৪.কমকে জানান, জরাজীর্ণ স্টেশন ভবন, লোকবলের অভাব, যাত্রীসেবা না থাকাসহ নানা সঙ্কটে জগতি স্টেশনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর