পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ কারাগারে পরিণত হয়েছে: সন্তু লারমা

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 02:34:19

পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক অবস্থা ভালো নয় জানিয়ে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ বড় কারাগারে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু আজ ২৪ বছর পর চুক্তি বাস্তবায়নের অবস্থা অনেক হতাশাব্যঞ্জক। গত ২৪ বছরে যে সরকারের আমলে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে সে সরকারই অধিকাংশ সময় ক্ষমতায় আছে আজ অবধি। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া একেবারেই থেমে আছে। পার্বত্য সমস্যা একটি রাজনৈতিক ও জাতীয় সমস্যা। যেহেতু এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা সেহেতু এটি রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। তার জন্যই চুক্তি করা হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার (০২ ডিসেম্বর) রাজধানী ঢাকার আগাওগাওঁস্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই যুগ পূর্তি উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের যৌথ আয়োজনে এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি।

জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, পার্বত্য সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকলেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় তা সমাধান হতে পারেনি। আজ প্রশ্ন করতে হচ্ছে, সরকার কেন চুক্তি করেছিল? পার্বত্য সমস্যাকে সমাধানের জন্য নাকি, জুম্ম জনগণের অস্তিত্বকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য। পার্বত্য জনগণ তাদের ভূমির অধিকার, অস্থিত্বকে সুরক্ষার জন্যই আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছিল। পাহাড়ের মানুষের যদি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকতো তাহলে পাহাড়ের জুম্ম জনগণ সরকারের সাথে আলোচনায় আসতো না বলেও দাবি করেন তিনি।

আজকে পার্বত্য অঞ্চলে জুম্ম জনগণকে যেভাবে শোষন, বঞ্চনা ও নিপীড়ন করা হচ্ছে তা বলার ভাষা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ বড় ধরনের কারাগারে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ দু’টি পক্ষ। একটি পক্ষ যারা পাহাড়ের নিরীহ মানুষ যারা চুক্তির বাস্তবায়ন চাই। আর আরেকটি পক্ষ সরকার এবং তার সাথে যুক্ত বিভিন্ন পক্ষ। সেখানে সরকারের সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব ও দমন-পীড়ন তো আছেই। তা বর্ণনাতীত বলেও মনে করেন তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চুক্তির বাস্তবায়ন চায় দাবি করে তিনি বলেন, জনসংহতি সমিতি চুক্তির আলোকে যে আইনগুলো প্রণীত হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন চায়। কিন্তু সরকার আজ জনসংহতি সমিতিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকর্মীদের নানাভাবে দমন-পীড়ন করা হচ্ছে। অনেক নেতাকর্মীকে আজ মামলা দিয়ে, হামলা করে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। বহিরাগত যে গরিব বাঙালিদেরকে জিয়াউর রহমান নিয়ে গিয়েছিল তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এখনো চলমান। তারা আজ পাহাড়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।

পাহাড়ের জুম্ম জনগণকে তথাকথিত শৃঙ্খলা, নিয়ম কানুন মেনে চলতে বাধ্য করা হচ্ছে, তা যেন এক ধরনের বড় কারাগার। তিনি আরও বলেন, সেখানে বলার অধিকার নেই, জীবিকার অধিকার নেই। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত পাহাড়ে আদিবাসী জনগণের জুম চাষ, আদা-হলুদ চাষের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি সম্বলিত চিঠিরও সমালোচনা করেন তিনি। পাহাড়ে যে ধরনের সেনাশাসন চলছে বাংলাদেশের অন্য কোথাও নেই। পাহাড়ের মানুষ শান্তিপ্রিয় বলে এখনো অপেক্ষা করছে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। চুক্তি যদি বাস্তবায়ন না হয় তবে পাহাড়ের ছাত্র যুব সমাজ নিশ্চয় রুখে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি। যে চুক্তি বিশ্বাস ও ভালোবাসা দিয়ে করা হয়েছিল তাতে সরকারের সততা ছিল কী না প্রশ্নও করেন তিনি।

বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, ২৪ বছর পর চুক্তি নিয়ে যে আনন্দ উচ্ছাস থাকার কথা ছিল তা আজ নেই বলে আমার মনে হয়। জিয়াউর রহমান যখন চরভাঙা গরিব বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তখন তরুণ সংসদ সদস্য হিসেবে আমরা বিরোধীতা করেছিলাম। পার্বত্য চুক্তিতে উপনীত হওয়ার সময় দু’টো দিক তুলে ধরেছিলাম। একটা হল- পাহাড়ে সামরিকায়ন বন্ধ করা এবং পুনর্বাসিত বাঙালিদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া। চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও সবার হাস্যজ্জ্বল চেহারা ছিল। এটার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেস্কো শান্তি পুরষ্কারও পেয়েছিলেন। কিন্তু আজ হয়ত সামরিক বন্দুকের জায়গায় অন্য কৌশল নেওয়া হয়েছে। এই করোনার সময়েও অন্তত ২০টি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো-চেয়ার ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, আমরা শান্তি চেয়েছিলাম বলেই চুক্তি করেছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি যা বাস্তবতা বলে দেয়। অন্তত শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে তার ন্যুনতমও বলতে পারি না। উল্টো একতরফাভাবে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়েছে বলে আমরা দেখেছি। আদিবাসী মানুষের আদি জীবিকার উপরও হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। তাদের সমাজ, সংস্কৃতি, পেশা, অর্থনীতি সবকিছুর উপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। একটা উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী যেটা করে সেটাই করা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। পার্বত্য চুক্তি সরকারি চুক্তি নয়। এটি তারা রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক নৈতিকতা থেকেই করা হয়েছে। কাজেই এই চুক্তি বাস্তবায়ন না করাটা রাষ্ট্রবিরোধী বলেও মনে করেন বিশিষ্ট এই মানবাধিকার কর্মী।

অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চুক্তি’র অন্যতম স্বাক্ষরকারী, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্রবোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। এছাড়া অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের কো-চেয়ার এডভোকেট সুলতানা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন ও বাংলাদেশ হিন্দু, বোৗদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ প্রমুখ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর