হোটেল রয়েল টিউলিপ-৪২০

, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 23:54:10

কক্সবাজার থেকে ফিরে: আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল শার্টলে হোটেল রয়েল টিউলিপে যাবো। কক্সবাজার এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে বেশ আনন্দ নিয়ে কোস্টারে (ট্যুরিস্ট কোচে) উঠলাম। গাড়িতে ওঠার পর জানানো হলো চাকা পাংচার হয়েছে আরেকটি বাস আসছে তাতে করে যেতে হবে।

রোদে দীর্ঘক্ষণ পার্কিংয়ে থাকায় কোচটিতে তেষ্টানো দায়। গরমে সেদ্ধ হওয়ার জোগাড় এসি চালু করার অনুরোধও প্রত্যাখ্যাত হলো। পরের বাস না আসা পর্যন্ত গরমের মধ্যেই অপেক্ষা। টিমের দ্বিতীয় ফ্লাইটের যাত্রীদের ক্ষেত্রে ঘটল ভিন্ন রকম বিপত্তি। ২টি আসন ফাঁকা থাকায় বাসটি ছাড়া হচ্ছে না। বলা হলো পরবর্তী ফ্লাইট এলে যাত্রী পূর্ণ হবে তারপর ছাড়বে। এদিকে গরমে যাত্রীদের ত্রাহী অবস্থা এবারও এসি ছাড়বার আবেদন নিষ্ফল হলো। তাদের সাফ কথা দাঁড়ানো অবস্থায় এসি চালানো নিষেধ রয়েছে। বাড়তি দুই আসনের ভাড়া দিতে চেয়েও কাজ হলো না। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণ নিয়ে মনের মধ্যে যে চনমনে ভাব ছিল তা মলিন হতে শুরু করলো কক্সবাজার নেমেই।

পরে চাকা গড়তে শুরু করলে কিছুটা স্বস্তি ফেরে এসির শীতল হাওয়া ও মেরিন ড্রাইভের নৈসর্গিক দৃশ্যে। সবাই তখন উদগ্রীব কতক্ষণে হোটেলে ঢুকবেন ড্রেস চেঞ্জ করে সমুদ্রে জলকেলি করবেন। মাত্র দুই দিনের সফরের একটি মুহূর্তও কেউ মিস করতে চান না। হোটেলে প্রবেশ করে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুঁই ছুঁই করছে প্রথম টিমের সদস্যরাই রুম পাননি। রিসিপশনে কথা বলেও কোনো সমাধান মিলল না। কখন রুম পাওয়া যাবে জানতে চাইলে বললেন, রুম রেডি হয়নি রেডি হলেই পাবেন। কখন পাবেন বলা সম্ভব না। এখানে বলে রাখা ভালো রিসিপশনে থাকা স্টাফদের কথাবার্তা ও আচরণ মোটেই পাঁচ তারকার সঙ্গে যায় না।

প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম কাপে দেওয়া হচ্ছে ড্রিংকস

গ্রুপ ট্যুরের হওয়ায় পূর্বেই হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি করা হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী দুপুর ২টার মধ্যে রুম দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।মৌখিকভাবে বলা হয়েছিল দুপুর ১২টার মধ্যে রুম দেওয়া হবে। সে কথা মনে করে দিলে জবাব এলো, রুম ফাঁকা না হলে আমাদের কিছুই করার নেই। অনেক প্রশ্নের এক উত্তর রুম রেডি হলেই পেয়ে যাবেন। টিমের সদস্য বাসসের সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ শুক্কুর আলী শুভ প্রশ্ন তুললেন আপনাদের তো ওয়েলকাম ড্রিংকস দেওয়ার কথা। রিসিপশন থেকে লবির দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ছোট্ট কফিশপ দেখিয়ে বললেন ওখান থেকে দেওয়া হয়। তাকে প্রশ্ন করা হলো এই ড্রিংকস কি গেস্টদের খুঁজে নিতে হয়, না আপনারা নিজে থেকে পরিবেশন করেন। কোনো উত্তর দিলেন না। এবার সেই কফিশপে গেলেন শুক্কুর আলী শুভ, সেখান থেকে জানানো হলো লবিতে বসেন আমরা নিয়ে আসছি। আমাদের টিমের সদস্য ৯০ জন, আরও অনেকে তখন রুমের অপেক্ষায়। ৫টি কাঁচের কাপ ও ৭টি ওয়ানটাইম কাপে করে জুস নিয়ে হাজির হলেন। ঠিক যেমন কয়েক দশক আগে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে প্লেট গ্লাস ধার করে এনে বিয়ে শাদী সারানো হতো। প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম কাপ নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করলেন। ছেলেটি জানালেন গ্লাস কমতো তাই ওয়ানটাইম কাপে করে দেওয়া হয়েছে। দুপুরে রেস্টুরেন্টেও একই হাল পানি খাওয়ার জন্য কাচের গ্লাসের পাশে প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম কফি কাপ সাজানো।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে ওয়েলকাম ড্রিংকসে কি ক্ষুধা মরে। বাধ্য হয়ে ব্যাগপোটলা নিয়ে দুপুরের খাবারে অংশ নিতে হলো। চলতে থাকল ভূড়িভোজ, এবার পিলে চমকানোর মতো অবস্থা, একজন অর্ধেক খাবার পর খাবারের মধ্যে মৃত মাছি আবিষ্কার করলেন। খাবার রেখে দ্রুত ছুটলেন বেসিনে। রেস্টুরেন্ট বয়কে দেখানো হলে খুব একটা অবাক হলেন বলে মনে হলো না, বললেন অনেক সময় মাছি উড়ে ঢুকে পড়ে। ছোট্ট করে বললেন সরি, কিন্তু সরিতে কি রুচি বাড়ে দুইবার বমি করে দুপুরে না খেয়ে উঠে পড়লেন তিনি।

পরদিন সকালের নাস্তায় বিজনেস ইনসাইডারের সাংবাদিক হাসান আজাদ আবিষ্কার করলেন খাবারের মধ্যে লম্বা চুল। এবারও বয়কে অবগত করা হলো, তিনি শুধু প্লেট বদলে দিয়ে দায় সারলেন। নাস্তা সেরে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে গিয়ে আরেক দফায় বিড়ম্বনা। ট্যুরের চুক্তিতে ছিল প্রত্যেকে একদিন করে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে আনলিমিটেড সময় উপভোগ করতে পারবেন। ডিউটি ম্যানেজারকে বলা হলো ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তিনি জানালেন সব বার্তা দেওয়া আছে আপনারা গেলেই উপভোগ করতে পারবেন।

ড্রিংকস দেওয়া জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে কফি কাপ ও কাচের গ্লাস

ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে গেলে বলা হলো আমাদের কাছে এমন কোনো বার্তা দেওয়া নেই। তখন চুক্তির কপি দেখালে বলেন, এমনটাতো দেওয়ার কথা না। কারণ ওয়াটার ওয়ার্ল্ড কমপ্লিমেন্টারি হয় না। কে চুক্তি করেছে আমাকে জানান তার বিরুদ্ধে আমি অভিযোগ করবো। আরও নানা রকম হম্বিতম্বি। চুক্তিতে তাদের পরিচালক (সেলস এন্ড মার্কেটিং) মাহমুদ রাসেলের স্বাক্ষর রয়েছে জানালে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে প্রবেশ করার সুযোগ দিলেন। এবার বললেন, রুম নম্বর বলতে হবে, এক রুমে দুটির বেশি রিস্টবেন্ড (এন্ট্রিপাস) দেওয়া সম্ভব না। তাকে জানানো হলো আমাদের রুম ৩৮টি আর ৮৮ পারসনের অনুমোদন রয়েছে। আপনি দিতে থাকেন, ৮৮ হয়ে গেলে আর দেবেন না। কাউন্টারে বসা স্টাফরা বললেন, এভাবে হবে না। হয় রুমের নামে দু’টি করে নিতে হবে, না হলে ৮৮টি দিয়ে দিচ্ছি আপনারা একজন দায়িত্ব নিয়ে বিতরণ করবেন, আবার ফেরার সময় গুণে বুঝিয়ে দেবেন। হারিয়ে গেলে প্রত্যেকটির জন্য ৩’শ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে। ওয়ার্টার ওয়ার্ল্ডের ভেতরের কাহিনী লিখলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। সেটি অন্য পর্বের জন্য রেখে দিলাম।

ওয়াটার ওয়ার্ল্ড থেকে একেকজন একেক সময়ে বের হওয়ার সময় রিস্টবেন্ড ফেরত দিতে চাইলে বলেন, এভাবে নিতে পারবো না। আপনারা ৮৮টি বুঝিয়ে দেবেন একবারে। বাধ্য হয়ে একজনের আনন্দ মাটি করে সারাদিন গেট পাহারা দিতে হলো রয়েল টিউলিপের গ্যাঁড়াকলে। মনে করেছিলাম এবার মনে হয় বিড়ম্বনার শেষ। পরদিন যেহেতু সকাল সকাল চেক আউট হতে হবে তাই বিল চাওয়া হলো। রাতে কম্পিউটারে প্রস্তুতকৃত একটি বিল দিলেন সিনিয়র ডিউটি ম্যানেজার সানাউল হক। তাকে বলা হলো পরদিন শার্টলের ভাড়া অগ্রিম নিয়ে নিতে। তিনি জানালেন, এটা আমাদের সিস্টেমে করা যাবে না। কালকে ব্যবহার করার পর আপডেট হবে। পিড়াপিড়ি করলে কম্পিউটার প্রিন্টের ওপর হাত দিয়ে লিখে দিলেন।

পরদিন সকালে বিল পরিশোধ করতে গেলে ডিউটি ম্যানেজার (নাইট ম্যানেজার) নাফিস মাহমুদ শাহরিয়ার নতুন করে বিল প্রিন্ট করলেন। তার দেওয়া বিলে টাকার অংকে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৮১৭ টাকা বেশি। রাতের বিলটি দেখালে বললেন আপনি ঘুরে আসেন আমি দেখছি কোথায় সমস্যা। দুপুরে যখন চেক আউট হতে যাচ্ছিলাম তখনও নাফিস মাহমুদ শাহরিয়ার বললেন ক্যাশ কাউন্টারে চলে যান সব ঠিক করে দিয়েছি। কাউন্টারে গেলে আবার কম্পিউটারে বিল প্রিন্ট করলেন ক্যাশিয়ার মনির। ওই কপিতে নানান ধরনের অসঙ্গতি। বিলের ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৪৯৯ টাকার একটি খরচ যোগ করে দেওয়া। তবে যোগফলে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৮১৭ টাকা বেশি। তিনি ওই টাকা জমা দিতে বললেন। বিলে ভুল এবং পূর্বের দু’টি বিল তাকে দেখালে শুরু হয় ভুল সংশোধনের পালা, এবার মনির ও নাফিস মাহমুদ শাহরিয়ার মিলে গলদঘর্ম হতে থাকলেন। তারা বলতে চাইলেন রাতের বিলটিতে ভুল ছিল আমরা যে বিলটি দিয়েছি এটাই প্রকৃত বিল। এটাই পরিশোধ করতে হবে।

এবার তাদের কাছে প্রত্যেকটি খাতের আলাদা বিল চাওয়া হলে ভুলটি বেরিয়ে আসে। দেখা যায় ভেতরে একটি বিল ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৪৯৯ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুরো অংকটি যোগ করা হয়নি। এবার ভুলটি ধরা পড়লেও তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা গেলো না। মনে হলো বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক বিষয়। পুরো হোটেলটিতে ফন্ট অফিস ম্যানেজার নাজিম, স্টাফ রাজ্জাক ও রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার আশিককে কিছুটা পেশাদার মনে হয়েছে কথা কাজে আচরণে। তারা সার্ভিস দিতে না পারলেও অন্তত বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিয়েছেন। অন্যদের আচরণ কিংবা কথাবার্তা কোনটাই অন্ততপক্ষে পাঁচতারকার সঙ্গে যায় না। যেটা তারা দাবি করেন। খানিকটা ভাড়াটে গুন্ডার মতো বলা চলে দরাজ গলা, বেশি কথা বললেই বুঝি ঘাড় মটকে দেবে। রুম সার্ভিসকে পেতে ঘড়ি ধরে কয়েক ঘণ্টা সময় অপেক্ষা করতে হতে হয়েছে অনেককে। রুমের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বলাই বাহুল্য। বাথরুম যথাযথ না হলেও এ কথা ঠিক হোটেলটির রুমগুলোর পরিসর বেশ ভালো, প্রশস্ত লবি থাকলে দুই দিকে মাত্র একটি করে টয়লেট। একসঙ্গে একজনের বেশি ব্যবহার করার উপায় নেই।

সার্ভিস দুর্বল প্রশ্নে স্টাফদের কথা হচ্ছে আজকে (৭ জানুয়ারি) ৪২০টি রুমে গেস্ট রয়েছে তাই সার্ভিস দিতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আর এই কথার সূত্র ধরেই একজনতো টিপ্পনি কেটে বললেন, সত্যিইতো তাই রয়েল টিউলিপ-৪২০ (ফোরটোয়েন্টি)। এখানে এরচেয়ে বেশি কি আশা করা ঠিক না। কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে অবস্থিত হোটেলটি নাম রয়েল টিউলিপ সি পার্ল বিচ রিসোর্ট এন্ড স্পা লিমিটেড হলেও রয়েল টিউলিপ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। সেবার মান নিয়ে বরাবরই অভিযোগ রয়েছে। একবার গেলে দ্বিতীয়বার যেতে চাচ্ছে না গ্রাহকরা। সে কারণে বিশাল পরিসরের এই রিসোর্টটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। আওয়ামী লীগ নেতার মালিকানায় হওয়ায় ট্যুরিস্ট পুলিশ কিংবা জেলা প্রশাসনও নাকি খুব একটা ঘাটাতে চান না। তাই তারা দিনদিন বেপরোয়া। আবার রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে দেশি বিদেশি এনজিও কর্মীদের অবস্থানের কারণে তাদের পোয়াবারো। ট্যুরিস্টদের সেবার প্রতি তাদের উদাসীনতা বড়ই দৃষ্টিকটু। সে কারণে অনেকেই মন্তব্য করলেন বিদেশি এনজিও কর্মীরা গেলে হোটেলটির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

কথা বলার জন্য একাধিকবার ফোন দিলেই পরিচালক (সেলস এন্ড মার্কেটিং) মাহমুদ রাসেল ফোন রিসিভ করেন নি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর