এখনও বাতাসে বইয়ের পোড়া গন্ধ, দোকানির চাপা কান্না

, জাতীয়

সুলতান মাহমুদ আরিফ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-09-01 02:09:08

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। আবার শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় জমজমাট হবে নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেট। তাই নতুন নতুন বই দিয়ে সাজানো হয়েছিল দোকানগুলো। করোনার রেশ কাটানোর ব্যস্ততা ছিল ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কিন্তু কয়েক মিনিটের আগুনের পুড়ে অঙ্গার হলো সেই স্বপ্ন!

নতুন বইয়ে সাজানো দোকানগুলোতে এখন পোড়ার গন্ধ। দোকানিদের শেষ সম্বল বলতে এখন পোড়া অক্ষরগুলো। যা দেখে গুমরে উঠছে তাদের চাপা কান্না।

আগুনে পুড়ে যাওয়া নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান গোছানোর চেষ্টা করছেন। পুড়ে যাওয়া বইয়ের ছাই সরানোর কাজ করছেন। অনেকেই যা অবশিষ্ট আছে তা দিয়ে আবার নতুন স্বপ্ন বুনছেন।

দোকানে আলো নেই, বই নেই, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছাই! এর মধ্যেই অন্ধকারে বসে আছেন মিরাজ হোসেন। নীলক্ষেত মায়ের দোয়া পাবলিকেশন্সের মালিক মো. মিরাজ হোসেন।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিরাজ জানান, আমার অবস্থা পথে নামার মত। করোনায় হওয়া ক্ষতি পুষিয়ে উঠার আগেই পথ নামিয়ে দিল আমাদের। আমার প্রায় ১৫ লাখ টাকার মত ক্ষতি হয়েছে। এমনিতেই করোনায় অনেক দেনা করে ফেলেছি, এখন আবার নতুন করে দোকান শুরু করলে ন্যূনতম ১০ লাখ টাকার প্রয়োজন। কোথায় পাব এত টাকা আমি! এটা বলেই আবারও নিরব হয়ে গেলেন মিরাজ।

বাবুল বুকস লাইব্রেরির স্বত্বাধিকারী মো. রাসেল বলেন, কয়েক মিনিটের মাথায় আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমার দোকানে সব মিলিয়ে ২৫ লাখ টাকার বই ছিল। মুহূর্তেই সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু বই না, আমার দোকানের পাঠাতনও পুড়ে ছাই। এখন বই বেচাকেনার সময়, ঠিক এই সময়টাতে এমন অবস্থা। খুব দ্রুত এমন অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করছি আমরা।

আর্কিড পাবলিকেশন্স এর মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, নতুন বছর, করোনার রেশ কাটিয়ে খুলছে স্কুল প্রতিষ্ঠান। এখন বই খুব ভাল চলবে,  এই আশায় নতুন বই তুললাম দোকানে। ৭-৮ লাখ টাকা মুহূর্তে আমার মাটির সাথে মিশে গেল।

শুধু সাইফুল, রাসেল কিংবা মিরাজ না, নীলক্ষেতের শাহজালাল বইয়ের  এই মার্কেটের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টি দোকানের মালিক ও কর্মচারীদের রয়েছে এমন চাপা কান্না। এখন কেউবা দোকান পরিষ্কার করছেন আর কেউ কিছু বই তুলে আবারও কোনরকম সাজাচ্ছেন স্বপ্ন।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটের মার্কেটটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও পুরোদমে আসতে সময় লাগে আরও কয়েক ঘণ্টা।

নীলক্ষেত শাহজালাল বইয়ের মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি রাজু বার্তা২৪.কম- কে বলেন, এখানে বারবার আগুন লাগার পিছনে কারণ চিহ্নিত করে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে একটা ব্যবস্থা নেব। এবারের আগুনে আমাদের প্রায় সাত কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। মেয়র বলেছেন আমাদের পাশে দাঁড়াবেন, অপেক্ষায় আছি। সরকার থেকে আমরা বহুতল ভবন নির্মানের অনুমতি পেয়েছি। কিন্তু আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ার কারণে এখনও করতে পারছি না।

নীলক্ষেতে এমন আগুন লাগার ঘটনা এবারই নতুন না। এর আগেও বেশ কয়েকবার আগুনে পুড়ে গিয়েছে জ্ঞান অর্জনের পাথেয় বই। ২০১২ সালের ২৭ জুলাই লাগা আগুনে প্রায় ২০টি দোকান পুড়ে যায়। ২০১৪ সালের ২৭ মার্চের আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ৩৬টি দোকান। এবং ২০১৭ সালের ২৬ মার্চ আগুনেও পুড়ে যায় বেশ কয়েকটি দোকান। সর্বশেষ এবার ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে পুড়ল প্রায় ৪০টি দোকান, যার ক্ষতি প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, গেল বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২১ হাজার ৬১টি। আর এতে ক্ষতি হয়েছে মোট ২১৮ কোটি টাকা। এছাড়া মারা গেছেন ২১৯ জন। গত ৫ বছরে ১৪৩৮ কোটি ৩১ লাখ ৪২ হাজার ৫৭২ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এসব ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৭৩২ জন।

রাজধানীতে বারবার এমন অগ্নিকাণ্ড কেন ঘটছে জানতে চাইলে প্রকৌশলী সালেহ আহমদ বলেন, আগুন লাগারোধে ফায়ার সার্ভিসের অনেকগুলো রুলস বলা আছে, যা আমরা অনেকটা মানি না। যার কারণে আগুনে প্রতিবছর আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বাসা বাড়িতে সাধারণত দুটো উৎস থেকে আগুন লাগে একটা হল ইলেক্ট্রিক সর্ট সার্কিট ‍আরেকটা গ্যাস সিলিন্ডার। মেয়াদ উত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করার কারণে বাসা বাড়িতে আগুন বেশি লাগছে।

তিনি বলেন, আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে প্রতিটা মার্কেটে সেফটি যন্ত্র রাখা দরকার, বছরে এক/দুবার আগুনের  মহড়া করা দরকার। তাহলে আগুন লাগলেও ক্ষতির সংখ্যা কম হবে মন্তব্য করেন তিনি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর