অশান্ত বিশ্বে মহামতি বুদ্ধের শান্তি ও কল্যাণের বার্তা

, জাতীয়

অধ্যাপক ড. উত্তম কুমার বড়ুয়া | 2023-08-31 22:17:09

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচয় বড় ধর্মীয় উৎসব শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। প্রতিবছর ইংরেজি মে মাসের পূর্ণচন্দ্র দিনে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটি পালন করে থাকেন। সেই সঙ্গে অনেক দেশে এই দিন জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের ৮০টি দেশ মহাসমারোহে দিনটি পালন করে থাকে।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে বৈশাখী পূর্ণিমাতিথিতে লুম্বিনী কাননে শালবৃক্ষের নীচে ভূমিষ্ঠ হয়ে এক মহাপ্রাণ সপ্তপদ্মে গমন করে তর্জনী তুলে সিংহনাদে ঘোষণা করলেন, ‘এ জগতে আমি অগ্র, আমিই জ্যেষ্ঠ; আমিই শ্রেষ্ঠ। এটাই আমার শেষ জন্ম, এর পর আমার আর জন্ম হবে না।’

অতঃপর, ৩৫ বছর বয়েসে নৈরঞ্জনা নদীর তীরে বোধিবৃক্ষমূলে সিদ্ধার্থ গৌতম ছয় বছর কঠোর সাধনা করে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমাতিথিতে রাতের প্রথম যামে জাতিস্মর জ্ঞান লাভ করলেন, মধ্যম যামে দিব্যচক্ষু জ্ঞান এবং শেষ যামে আসর-ক্ষয় জ্ঞান ও প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি অধিগত হলেন; সম্যক সম্মুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করেন এবং আবিষ্কার করলেন মহান সত্য-চারি আর্যসত্য ও দুঃখ মুক্তির পথ আর্য্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। সুদীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছর বুদ্ধের সকল জীবের দুঃখ মুক্তির ধর্ম প্রচার করে অশীতি বয়েসে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে কুশীনারার উপবর্তনে যুগ্মশাল তরুমূলে চিরনির্বাপিত হলেন মহামানব জগজ্জ্যোতি, পরিনির্বান লাভ করলেন, অনিচ্চা বত সংখ্যারা। তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ত্রিস্মৃতি বিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমা বা বৌদ্ধ পূর্ণিমা দিনে চেতনা প্রবাহে ধর্মের পবিত্র অবগাহনে সারাদিন মেতে উঠেন।

আর বুদ্ধ পূর্ণিমার এই পবিত্র দিনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিবেদনে বলেন, ‘আমি যাকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি, আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তার জন্ম উৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি। এ কোন বিশেষ অনুষ্ঠানের উপকরণগত অলঙ্করণ নয়, একান্তে নিভৃতে যা তাকে বার বার সমর্পণ করেছি সেই অর্ঘ্যই আজ এখানে উৎসর্গ করি।’

এই দিনকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে বলা হয়ে থাকে। নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ-বুদ্ধ পূর্ণিমা/বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধ জয়ন্তী হিসেবে পালন করে থাকে। লাওসে বিশাখ পূজা, ইন্দোনেশিয়ায় বৈসাক ডে, মালয়েশিয়ায় বেসাক ডে, মিয়ানমারে কাসন পূর্ণিমা, সিঙ্গাপুরে বেশাখ ডে, বুদ্ধ ডে, ওয়াসাক ডে, তিব্বতে সাকা দাওয়া, থাইল্যান্ডে বিশাখ বুচা ডে, ভিয়েতনামে ফাত ড্যান, মঙ্গোলিয়ায় ওদোর, কোরিয়ায় হানজা, জাপানে হানমাতসূরী/কানবুতসু, চীনে পিনইন, রাশিয়ায় গৌতমী বাড্ডি, ম্যাকাও, হংকং, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে বেশাখ ডে’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে।

১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব জাভিয়ার পেরেজ দ্য-কুয়েলার বলেন, ‘মানবতার সেবার প্রতি তার দেওয়া শিক্ষা, সহানুভূতি; সকল জীবের মঙ্গল কামনা ও নিষ্ঠার বার্তা উদযাপন সত্যি একটি সম্মানজনক সুযোগ। বুদ্ধের শান্তির বার্তা বর্তমান অশান্ত পৃথিবীতে আগের চেয়ে সম্ভবত আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।’

১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে শ্রীলঙ্কার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষণ কাদির গামা মহামতি বুদ্ধের মানবতার, মৈত্রীর, সাম্য ও শান্তির দর্শনের জন্য, সকল জীবের কল্যাণের জন্য বুদ্ধের ত্রিস্মৃতি বিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি, পালন ও দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করা হলে সর্বসম্মতি ক্রমে-জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৫৪/১১৫, রেজুলেশন গৃহীত হয় এবং এই দিনকে আন্তর্জাতিক ‘Vesak Day’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও শান্তিকামী মানুষের জন্য এই সিদ্ধান্ত বিরল সম্মান বয়ে আনে।

ইউনেস্কা’র সদর দফতরে, ফ্রান্সে প্রতিবছর ঝাঁকজমকপূর্ণ ভাবে মহাসমারোহে মে মাসের পূর্ণচন্দ্রতে বেশাখ ডে উদযাপন করা হয়ে থাকে। এই লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কার স্থায়ী প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি যোগ দেন। প্রতি বছর বেশাখ ডে উপলক্ষে ইউনেস্কো স্লোগান নির্ধারণ করে থাকে।

যেমন-২০১৪ সালের স্লোগান ছিল, ‘Inter Faith and inter cultural awareness towards peace’, ২০১৫ সালের স্লোগান ছিল, ‘Fostering world peace through cultural education’, ২০১৬ সালের থিম স্লোগান ছিল, ‘Prayer for peace’, ২০১৭ সালের স্লোগান ছিলো, ‘peac Buddist teaching for social and sustainable world peace’; ২০১৮ সালের থিম ছিলো, ‘Promotion of peace and Non-Violence: Buddha’s way of life’, ২০১৯ সালে থিম ছিলো, ‘Reflects the UN’s 17 sustainable development goals’, ২০২০ সালের থিম ‘To practice love, peace and harmony as taught by the Buddha’.

২০২০ সালের জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘On the Day of Vesak, Let us celebrate Lord Buddha’s wisdom by talking actions for others with compassion and solidarity and renewing our commitment to build a peaceful world’.

বাংলাদেশে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ পূর্ণিমা যথাযোগ্য মর্যাদায় আনন্দের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অন্যান্য দেশের মতো পালন করে থাকলেও জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বেশাখ ডে’ বাংলাদেশি বৌদ্ধরা গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি তুলে ধরেননি। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানের উদ্যোগে বেশাখ ডে অফ ইউএন নিয়ে ভাবা হচ্ছে, কেউ কেউ আলোচনার টেবিলে ঝড় তুলছেন। তবু কেন জানি এই নামকরণকে সঠিকভাবে উপস্থান করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি।

আমাদের দেশ অসাম্প্রদায়িক। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বার বারই বলেন, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ তাই যদি হয়, তবে ঈদ, দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বড় দিনের উৎসব সবার। হাজার বছর ধরে এই বাংলায় তাইতো আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির চর্চা মেধা-মনন মানসিকতার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রস্তাব, বুদ্ধ পূর্ণিমা সমারোহে পালন করা হোক যথানিয়মে, আবার ‘বেশাখ ডে অব ইউএন’ এর মোড়কে প্রতি বছর ইউনেস্কোর প্রতিনিধিসহ সকল ধর্মের অংশগ্রহণেও পালন করা হোক।

পরিশেষে, আমাদের প্রার্থনা-আমরা যেন অবিদ্যাকে জয় করে, তৃষ্ণাকে ক্ষয় করে; শীলে পরিশুদ্ধ হয়ে, কুশল কর্ম সম্পাদন করে লোক-দ্বেষ-মোহ মুক্তির জন্য নিজেকে প্রতিনিয়ত অনুশীলনের মাধ্যমে নির্বাণ সুখ কামনায় নিজেকে প্রস্তুত করি। সকল প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক। বুদ্ধ পূর্ণিমা, বেশাখ ডে অব ইউএন সফল হোক, সার্থক হোক।

লেখক: বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচারসংঘের সহ-সভাপতি

এ সম্পর্কিত আরও খবর