মাইকে গান বাজেনি, তাই বিয়ে বন্ধ

ময়মনসিংহ, জাতীয়

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-27 17:31:15

‘প্রায় ৩৮ বছর আগের কথা। তখন আমার ব্যবসার খুব নাম ডাক। একদিন গাঁও গৌরীপুর গ্রামের এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গান বাজানোর জন্য বরপক্ষ আমার মাইক ও গ্রামোফোন ভাড়া করে। কিন্তু বিয়ের আগের দিন বেকুরহাটি বাজারে একটি ভাড়ার কাজ শেষ করে গাড়ি না পাওয়ায় গৌরীপুর ফিরতে আমার একটু দেরি হয়। তাই ওই দিন বিয়ে বাড়িতে গান বাজাতে পারিনি। কিন্তু নাছোড়বান্দা বরের হুঁশিয়ারি- ‘গান-বাজনা না হলে সে কনে আনতে যাবে না’। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় বিয়ের সব আয়োজন । এদিকে বিয়ে ভাঙার শঙ্কায় কনের বাড়িতে পড়ে যায় কান্নার রোল। এই খবর আমার কাছে পৌঁছালে আমি অনেক রাতে বরের বাড়িতে গিয়ে ঘটনা খুলে বলি। আয়োজন করি গান বাজনার এবং পরের দিন বর ধুমধাম করে কনে আনতে চলে যায় শ্বশুরবাড়ি।’

নিজের চল্লিশ বছরের মাইক ব্যবসার একটি ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতার কথা এভাবেই বার্তা২৪.কমের কাছে তুলে ধরেন ‘আকবর মাইক সার্ভিসের’ মালিক মো. আকবর আলী (৫৬)। তার বাড়ি গৌরীপুর পৌর শহরের পূর্বদাপুনিয়া গ্রামে। বাবা মৃত-আব্দুল আজিজ। চার ভাই চার বোনের মধ্যে আকবর তৃতীয়। আকবরের বাবা গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে গ্রামোফোনে গান বাজিয়ে টাকা উপার্জন করতেন। অভাবের তাড়নায় বাবার সূত্রেই এই পেশায় আসা তার।

গত মঙ্গলবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে পৌর শহরের হারুন টি হাউজে বসে এ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় আকবরের। ব্যবসা জীবনের নানা অভিজ্ঞতার গল্প তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর গ্রামোফোনের গান বাজানোর জন্য ২১শ টাকায় একটি মাইক কিনি। এরপর বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানে গ্রামোফোনের গান মাইকে বাজানো শুরু করি। ধীরে ধীরে ব্যবসার পরিধি ছড়িয়ে পড়ে গৌরীপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে।’

নব্বই দশকে টেপরেকর্ডারের আগমনের পর গ্রামোফোনের বিলুপ্তি ঘটে। ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ে আকবরের। এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইক ভাড়া দেয়ার মধ্য দিয়েই ব্যবসাটাকে আগলে রাখেন তিনি। তবে দোকানের মালামাল চুরি, অনুষ্ঠানে মাইক ভাঙচুর ও টাকা না পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা তার মনে দাগ কেটেছে। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে নিঃস্ব আকবর আলী এখন প্রতিষ্ঠিত। মাইকের ব্যবসা করে নিজের নামে জমি-বাড়ি করেছেন।

আকবর জানান, চুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান মাইকে প্রচারণার জন্য সর্বনিম্ন ৫শ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা নেন তিনি। প্রতি মাসে তার আয় হয় ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু মাইকের ব্যবসা করার কারণে অনেকই তার সঙ্গে খারাপ আচরণ ও কটূক্তি করে। তবে এসব নিয়ে তার অভিযোগ নেই।

এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যস্ততা বেড়েছে আকবর মাইক সার্ভিসের। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকেই শহরের অলি-গলিতে প্রার্থীদের গুণকীর্তন করে মাইকে প্রচারণা চালাবেন আকবর আলী। তাই আগাম প্রস্তুতি চলছে তার দোকানে।

আকবরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এক ব্যক্তি এসে বলেন’ ‘আকবর ভাই একটা প্রোগ্রামের মাইকিং করতে হবে, কত টাকা লাগবে?’ এ সময় হেসে আকবর জবাব দেয় ‘আপনার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে কী কথা বলা লাগবে? হিসাব করে দিয়ে দিয়েন।’

স্থানীয়রা জানান, গত দুই যুগে আকবরের দেখা-দেখি ১০-১২ জন ব্যক্তি এই পেশায় এসেছিলেন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় সবাই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন একমাত্র আকবরই এই পৌর শহরে পেশাটাকে ধরে রেখেছেন।

জানা গেছে, দাম্পত্য জীবনে আকবরের রনি, জনি নামে দুই ছেলে ও জহুরা নামে এক মেয়ে রয়েছে। ব্যবসার জমানো টাকা দিয়ে কয়েক বছর আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর