‘সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছে শুধাই/ বল আমারে তোর কি রে আর কূল কিনারা নাই...।’ বিখ্যাত এই পল্লীগীতি গানে ফুটে উঠেছে খরস্রোতা পদ্মা নদীর বিশালত্ব ও আগ্রাসী রূপ। এই প্রমত্তা পদ্মায় বিলীন হয়েছে কত বাড়ি ঘর। পাড়ি দিতে গিয়ে খরস্রোতা পদ্মা কেড়ে নিয়েছে হাজারো প্রাণ। যদিও আগের সেই প্রমত্তা পদ্মার আগ্রাসী রূপ অনেকটাই বিলীন। এই নদীতে এক জয়ের অ্যাখ্যান কাব্য লিখে ৬ মিনিটে পদ্মা পাড়ি দিতে নির্মিত হয়েছে এক স্বপ্ন সেতু।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে লঞ্চ, ট্রলার, স্পিডবোট এবং নৌকায় সীমাহীন ভোগান্তিকে সঙ্গী করে পাড়ি দিতে হত পদ্মা। এই অঞ্চলের মানুষের বহু বছরের স্বপ্ন ছিলো তাদের যাতায়াতের বড় বাধা পদ্মার ওপর একটি সেতুর। যে সেতু রাজধানীর সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাবে, দূর করবে যাতায়াতের দুর্ভোগ। আর মাত্র ১৩ দিন, তাদের সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। ২৫ জুন উদ্বোধন হবে বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই দিন সকাল ১০টায় পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচন করবেন। মাত্র ৬ মিনিটে বিশাল প্রমত্তা পাড়ি দেবেন তিনি ও সেই সঙ্গে তার স্বপ্নও।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু শুধু যাতায়াতের কষ্ট দূর করবে তা নয়, এ সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাবে। যার প্রভাব পড়বে গোটা দেশের অর্থনীতিতে। গোটা দেশ তাকিয়ে আছে ২৫ জুনের দিকে।
রোববার (১২ জুন) মাওয়া প্রান্তে সরেজমিনে দেখা যায়, উদ্বোধনের আগে সেতুর শেষ সময়ের গোছানোর কাজ চলছে। ২৫ জুনের মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য শ্রমিকরা ব্যাপক ব্যস্ত সময় পার করছেন। শেষ মুহূর্তের কাজ সারতে সেতুর ওপর কয়েকটি গাড়ি চলাচল করছে। ল্যাম্পপোস্টের কাজও শেষ। চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ।
এদিকে সেতু উদ্বোধনকে ঘিরে উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ঐতিহাসিক এ মাহেন্দ্রক্ষণকে ধরে রাখতে বর্ণাঢ্য আয়োজন সাজিয়েছে সরকার। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের জাজিরা প্রান্তে চৌধুরী ঘাটে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ৩০ জুন পযর্ন্ত চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এদিন মাওয়া প্রান্তে সেতু পরিদর্শন শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শেখ হাসিনার একক প্রচেষ্টার ফল পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু শুধু দেশের গর্বের না, এ সেতু দেশের সাহসের প্রতীক, মযার্দার প্রতীক। বহু ত্যাগ তিতিক্ষা সহ্য করতে হয়েছে সেতু নির্মাণে। বছরের পর বছর মানুষ ভোগান্তি সহ্য করে যাতায়াত করেছে। কতপ্রাণ বলিদান নিয়ে এ নদী তার হিসাব নেই। এখন মানুষ মাত্র ৬ মিনিটে পদ্মা পাড়ি দেবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে পিছনের ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, পদ্মা সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখা শুরু হয় এক যুগ আগে থেকে। নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ২০১২ সালে দেশীয় অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তের পর শুরু হয় নির্মাণ কাজ। এর প্রায় এক দশক পর ২৫ জুন চালু হতে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
২০০৭ সালের আগস্টে পদ্মা সেতু একনেকে অনুমোদন পায়। সে সময় ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১০ সালের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হয়ে যায়। পরের বছর জানুয়ারিতে ডিপিপি সংশোধন করা হয়। প্রথমবারের মতো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কারণ প্রথমে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। পরে তা বৃদ্ধি করে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এরপর আরও তিনবার পদ্মা সেতুর ব্যয় বাড়ানো হয়। শেষে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় নির্মিত হয় পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। এরপর একে একে সব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করে।
এরপর আসে সেই সাহসী সিদ্ধান্ত। ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সাফ জানিয়ে দেন কারো টাকা লাগবে না। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু হবে। প্রধানমন্ত্রীর সেই সাহসী সিদ্ধান্তে আজ বাঙালির টাকায় প্রমত্তা পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতু।
যদিও পরবর্তীতে দুদক ও কানাডার টরন্টোর এক আদালত পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কোন প্রমাণ পায়নি। এমনকি বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে অর্থলগ্নি ফেরত নেওয়াকে ভুল বলেও শিকার করে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, আসছে ২৫ জুন ভয়ংকর ও শক্তিশালী পদ্মাকে জয় শুধু সেতু নির্মাণ হচ্ছে তা নয়, চাপা পড়ছে শত অপমান আর সমালোচনাও। আর সেই সঙ্গে জয় হবে বাঙালির আবেগ, সাহস ও মযার্দারও।