দেশের পর্যটন মানচিত্র পাল্টে দেবে পদ্মা সেতু। খুলনাকে হটিয়ে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার হবে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। পর্যটক আগমনের দিক থেকে কক্সবাজারকেও চ্যালেঞ্জে ফেলে দিতে পারে কুয়াকাটা।
ট্যুর অপরেটর ও কুয়াকাটার পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানান, পদ্মা সেতুর আগেই উদ্বোধন হয়েছে লেবুখালী পায়রা সেতু। এ দুই পয়েন্টে এখন ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্ভোগ পোহাতে হয় কুয়াকাটাগামী যাত্রীদের। লেবুখালী সেতু চালু হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে সড়ক পথে কুয়াকাটা যেতে ৬ ঘণ্টার কম সময় লাগবে।
কুয়াকাটা একদিকে যেমন সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ করে দেবে অন্যদিকে খুব কম সময়ে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট—কচিখালী, কটকা সৈকত, জামতলা সি বিচ, সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে জেগে ওঠা দ্বীপ পক্ষীর চর, ডিমের চর ঘুরে দেখার অপার সুযোগ সৃষ্টি করবে। কটকাতে হরিণপালের বিচরণ দেখতে অনেকেই ছুটে যান সেখানে। খুলনা শহর থেকে নদী পথে কটকা যেতে হলে সময় লাগে ১৫ ঘণ্টার মতো, আর মংলা থেকে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা।
তবে কুয়াকাটা থেকে কটকায় পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো। খুলনা থেকে ওই স্পটে যেতে হলে রাত্রিযাপন ছাড়া ফিরে আসা সম্ভব না। কিন্তু কুয়াকাটা থেকে সকালে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা হরিণের সান্নিধ্যে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসা সম্ভব।
কুয়াকাটার পশ্চিম দিকে সুন্দরবন যেমন পর্যটকদের হাতছানি দেয় তেমনি পূর্ব দিকেও রয়েছে পর্যটনের বিশাল ভাণ্ডার। যার কথা মাথায় এলেই পর্যটকদের মন আনচান করে ওঠে। কিন্তু সময়ের অভাবে যেতে পারেন না অনেকে। সেই পর্যটন ভাণ্ডার চর কুকরি মুকরি, ঢাল চর, চর নিজামও কুয়াকাটার হাতের নাগালেই।
ঢাকা থেকে রাতে গিয়ে দিনের বেলা ঘুরে পরের রাতেই ঢাকায় ফেরা সম্ভব হবে। ছুটির দিনটি দারুণভাবে উপভোগ করা যাবে সেখানে। আর যাদের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র-শনি, পদ্মা সেতু হলে তারা তো সোনায় সোহাগা। খরচও থাকবে সাধ্যের নাগালে।
শুধু কি সুন্দরবন, সাগরকন্যা কুয়াকাটার নিজেরও রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে একদিকে যেমন রয়েছে সূর্যাস্ত উপভোগ করার সুযোগ, তেমনি রয়েছে অপরূপ সূর্যোদয়। রয়েছে সৈকতকেন্দ্রিক পর্যটকপ্রিয় কার্যক্রম। সৈকতের কিটকটে হেলান দিয়ে মুখে পুরতে পারবেন সাশ্রয়ী মূল্যে সামুদ্রিক মাছের ফ্রাই ও বারবিকিউ। বর্ষা মৌসুমে রাতের নির্জনতাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় সাগরের গর্জন। প্রথমবার গেলে রীতিমতো বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতে সক্ষম সমুদ্রের গগনবিদারি ডাক।
কুয়াকাটার গা ঘেঁষে অবস্থিত ফাতরার চর, লাল কাকড়ার চর, শুঁটকি পল্লি, লালদিয়ার চর, চর বিজয়, ফকিরহাট, সোনার চর, ক্র্যাব আইল্যান্ড বা কম কিসে? একটি স্পট থেকে আরেকটির প্রকৃতি ভিন্ন, রয়েছে ভিন্ন রকম জীব-বৈচিত্র্য। এক কথায় বলতে গেলে একটির চেয়ে আরেকটি বেশি আকর্ষণীয়। দারুণ সময় কাটাতে চাইলে এসব স্থানের জুড়ি মেলা ভার।
আরও অনেক স্পট রয়েছে যেগুলো পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। নানান দিক বিবেচনায় পর্যটনের নতুন গন্তব্য মনে করা হচ্ছে কুয়াকাটাকে। শুধু কি সড়কপথ কুয়াকাটাকে কাছে এনে দিচ্ছে তা কিন্তু নয়। এর খুব কাছেই পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে রয়েছে বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা।
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, চাকামইয়া ইউনিয়নে এয়ারপোর্টের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। শিগগিরই ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হতে যাচ্ছে। কুয়াকাটা সৈকত থেকে যার দুরত্ব হবে ৮ কিলোমিটারের মতো।
বিমানবন্দরের দিক থেকেও খুলনাকে টেক্কা দিতে যাচ্ছে কুয়াকাটা। খুলনায় বিমানবন্দর নেই, আকাশ পথে যেতে চাইলে যশোর ঘুরে যেতে হয়। বলা যায় কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে চলছে উন্নয়ন যজ্ঞ। যারা ২০১০ সালের আগে সেখানে গেছেন তারা এখন গেলে এলাকাটিকে চিনতে পারবেন না। বিশাল বিশাল সড়ক চলে গেছে গ্রামের আনাচেকানাচে।
চমক থাকছে রেললাইনেও। ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা যাচ্ছে রেলপথ। প্রথম ধাপে বরিশাল পর্য়ন্ত লাইনের কাজ শেষ হবে। এরপর ২০২৫ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে কুয়াকাটা। চার ঘণ্টায় বরিশাল আর সাড়ে ৫ ঘণ্টায় কুয়াকাটা পৌঁছে দেবে পর্যটকদের। আর চাইলে নদী পথে যাওয়ার সুযোগ তো রয়েছেই। আধুনিক ও বিলাসবহুল অনেক লঞ্চ চলাচল করছে বরিশাল রুটে।
যাত্রী বেড়ে গেলে আরও অনেক বড় বড় কোম্পানি লঞ্চ নামানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পূর্ব-পশ্চিমমুখী কোনো মহাসড়ক নেই। চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালী থেকে বরিশাল যেতে হলে ঢাকা ঘুরে যেতে হয়। বর্তমান সরকার পূর্ব-পশ্চিমে হাইওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে।
উপকূলীয় জেলা ছুঁয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে পায়রা-মংলা হয়ে বেনাপোলকে সংযুক্ত করা হবে অদূর ভবিষ্যতে। অর্থনৈতিক এই মহাসড়ক পর্যটনকেও দারুণভাবে নাড়িয়ে দেবে। বিভিন্ন অংশে মহাসড়কের কাজ এগিয়ে চলছে, শুধু ভোলায় তেঁতুলিয়া নদীতে ব্রিজ করা হলে চট্টগ্রাম থেকে পায়রা কিংবা বেনাপোল যেতে হলে ঢাকা ঘুরে যেতে হবে না। সোজা চলে যেতে পারবেন পর্যটকরা।
কুয়াকাটার প্রথম বেসরকারি উদ্যোক্তা কুয়াকাটা হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কুয়াকাটা গেস্ট হাউসের প্রতিষ্ঠাতা এম এ মোত্তালেব শরীফ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে সামনে তুলে আনে। বিচ কার্নিভালসহ নানা উদ্যোগের কারণে অল্পদিনেই কুয়াকাটা মানুষের আগ্রহের জায়গায় পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, এক সময় কুয়াকাটা যেতে হলে বরিশাল পার হওয়ার পর সাত-আটটি ফেরি পার হতে হতো। এখন সেসব নদীতে ব্রিজ নির্মিত হওয়ায় যাতায়াত অনেক সহজ হয়েছে। ছুটির দিনগুলোতে কুয়াকাটায় থাকে উপচেপড়া ভিড়। অনেক সময় হোটেলে রুম না পাওয়ায় মানুষের বাসা-বাড়িতে থাকতে দেখেছি ট্যুরিস্টদের।
কুয়াকাটার সব হোটেল-মোটেল মিলে এখন আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে ছয় থেকে সাত হাজারের মতো। একদিনে ২০ হাজার ট্যুরিস্টের রেকর্ড রয়েছে বলে জানান কুয়াকাটা গেস্ট হাউসের প্রতিষ্ঠাতা।
এম এ মোত্তালেব শরীফ বলেন, এখন বরিশাল থেকে কুয়াকাটা যেতে লোকাল বাসে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা লেগে যায়। অথচ প্রাইভেটকার নিয়ে গেলে মাত্র দেড় ঘণ্টার পথ। লোকাল বাসগুলো থেমে থেমে চলে, যে কারণে ট্যুরিস্টরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এখানে যদি ভালো বাস নামানো যায় অথবা ট্যুরিস্টদের জন্য পৃথক বাস সার্ভিস হয় তবে পাল্টে যাবে চিত্র। আমরা পর্যটন মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনকে বলেছি, তারা না পারলে আমরা ট্যুরিস্ট বাস নামাতে চাই।
অভিজাত হোটেল খান প্যালেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরুণ উদ্যোক্তা রাসেল খান বার্তা২৪.কমকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে অনেক বাধা দূর হয়ে যাবে। এখন বিলাসবহুল কোম্পানিগুলোর বাস কুয়াকাটা পর্যন্ত আসে না। বরিশাল তাদের শেষ গন্তব্য। সেতু চালু হলে দেখবেন অনেক বিলাসবহুল বাস এ রুটে চলাচল করবে।
রাসেল খান বলেন, এক সময় মৌসুমেই ট্যুরিস্ট পাওয়া যেত না। এখন অফ সিজনেও ছুটির দিনে ট্যুরিস্টদের জায়গা দিতে পারি না। পদ্মা সেতু হয়ে গেছে, এখন কয়েকগুণ ট্যুরিস্ট বেড়ে যাবে। তখন মানুষ আর খুলনা হয়ে সুন্দরবন যাবে না। তারা সোজা কুয়াকাটা হয়ে সুন্দরবনে যেতে আগ্রহী হবে। এতে একদিকে যেমন সময় বাঁচবে, তেমনি ভ্রমণ খরচ কমবে।
বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু আগামী ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে। এটি দেশের পদ্মা নদীর ওপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে। দুই স্তরবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির উপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়কপথ এবং নিচের স্তরটিতে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় এ সেতু।