প্রস্তুত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এখন চলছে উদ্বোধনের ক্ষণ গণনা; এখান থেকে পাড়ি দিবে দক্ষিণাঞ্চল ও দেশের উন্নয়নের স্বপ্ন। পদ্মা সেতু- যেন কঠিনকে বাস্তব করার গল্প। ১৬ কোটি মানুষের সক্ষমতার দম্ভ। আমরাও পাড়ি এই কথাটা, নতুন করে বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়ার সাহসিকতাও।
নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সাহসিকতা প্রতীক পদ্মা সেতু। শনিবার (২৫ জুন) পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মহেন্দ্রক্ষণ। এই সেতুর স্বপ্নের বাহক শেখ হাসিনার হাত ধরেই দেশের উন্নয়নের এ দ্বার খুলে যাবে।
‘সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই/ বল আমারে তোর কি রে আর/ কুল কিনারা নাই, কুল কিনারা নাই/ ..... সকাল বেলা ধরলাম পাড়ি আমার দিন যে গেল সন্ধ্যা হলো/ তবু না কুল পাই।’
আব্দুল লতিফের কালজয়ী এই গানে রয়েছে পদ্মা পাড়ের মানুষদের চিরকালীন চাপা এক বেদনার গল্প। যেই গল্প ছিল শুধু ভয় এবং অনিশ্চিতয়তার। সেই অনিশ্চয়তা এবং সকল ভয়কে ঠেলে নিয়ে নতুন গল্প রচনা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যে-গল্প ভয়কে জয় করার গল্প, যে গল্প সকল ষড়যন্ত্রকে রুখে দেওয়ার গল্প। যার মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের পুরোনো কষ্ট, দুর্দশা ও দুশ্চিন্তার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে। সেই সঙ্গে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে ফিরে পাবে এক প্রাণ।
উদ্বোধনের পরের দিন রোববার (২৬ জুন) সকাল ৬টা থেকে থেকে যানচলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে পদ্মা সেতু। এতে ফেরি, লঞ্চ বা স্পিডবোটে বিপদসংকুল পদ্মা পাড়িতে অগণিত প্রাণও আর ঝরে পড়বে না।
পদ্মা সেতু দেশের যোগাযোগে যেমন প্রভাব ফেলবে তেমনি অর্থনীতিতেও একটি বড় প্রভাব রাখবে। ধারণা করা হচ্ছে এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার জন্য পদ্মা সেতুকে দেখা হচ্ছে উন্নয়নের মডেল হিসেবে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, পর্যটন, ইকোপার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক যাত্রী চলাচল ও বাণিজ্য যোগাযোগের বড় রুটকে সংযুক্ত করবে পদ্মা সেতু। আবার মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে।
দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিমায়িত মৎস্য ও পাটশিল্প। খুলনা থেকে রফতানি। পদ্মা সেতু হলে এই আয় আরও বাড়বে।
পদ্মা সেতুকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত মোংলা বন্দরের ব্যবসায়ীরা। কারণ সেতুর সাথে সাথে সড়ক যোগাযোগের উন্নয়নের ফলে এ বন্দরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবকাঠামোগত যেমন উন্নয়ন হবে তেমনি শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও ব্যাপক প্রসার ঘটবে।এ অঞ্চলে গড়ে উঠবে বিভিন্ন ধরণের ভারী শিল্প কলকারখানা
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এ বন্দর থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহণে সময় লাগবে মাত্র ৩ ঘণ্টা। মোংলা বন্দর থেকে সরাসরি চট্রগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহনে সময় লাগত ১৪ ঘণ্টা। সেতুর কারণে তা কমে এখন হবে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। যা তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পুঁজি তো বটেই অর্থনৈতিকভাবে লাভবানও হবেন তারা।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে স্বপ্ন দেখছেন শরীয়তপুরের মাছচাষিরা। অল্প সময়ে তাদের মাছ ঢাকার বাজারে পাঠাতে পারবেন। এতে বেঁচে যাবে পরিবহন খরচ, দামও পাবেন বেশি।
দেশের পর্যটন মানচিত্র পাল্টে দেবে পদ্মা সেতু। খুলনার সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার হবে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। পর্যটক আগমনের দিক থেকে কক্সবাজারকেও চ্যালেঞ্জে ফেলে দিতে পারে কুয়াকাটা।
এছাড়া কৃষি পণ্যের জন্য ব্যাপক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে পদ্মা সেতু। অল্প সময়ের মধ্যে কৃষি পণ্য পরিবহন করে কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন হবে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে।
পদ্মা সেতুর চালুর ফলে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ঘাটে ফেরির জন্য দীর্ঘ লাইন ও অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে যাচ্ছে। ঈদ-পার্বণ ও বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে জীবন বাজি রেখে যাত্রীদের আর বিশাল ও উত্তাল পদ্মা নদী পাড়ি দিতে হবে না। লঞ্চডুবির মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ৯ জুলাই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর মূল সেতুর কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টম্বর সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের উপর প্রথম স্প্যান বসানো হয়। মূল্য সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। সংযোগ সড়ক সহ সেতুর দীর্ঘ ৯.৭৫ কিলিমোটার।
পানি প্রবাহের দিক দিয়ে পৃথিবীতে আমাজন নদীর পরই অবস্থান পদ্মার। প্রমত্তা এই নদীতে সেতু নির্মাণ সহজসাধ্য ছিল না। এজন্য সেতু নির্মাণ করতে দিয়ে বিশ্ব রেকর্ডও হয়েছে। নদীশাসন, পাইল ও বিয়ারিংয়ে বিশ্ব রেকর্ড গেড়েছে পদ্মা সেতু।
এছাড়া নদীর তলদেশের মাটি নরম হওয়ায় ওইসব স্থানের ১১টি পিলারের নিচে স্কিন গ্রাউন্টিং পদ্ধতিতে সাতটি করে পাইল রয়েছে। পদ্মা সেতুতে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এর ক্যাপাসিটি ৯৮ হাজার কিলোনিউটন। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে এ সেতুর। গত ২২ জুন উদ্বোধনের কয়েকদিন আগে নির্মাণকাজ শেষ করে সেতু বিভাগকে পদ্মা সেতু বুঝিয়ে দিয়েছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি)।