জলবায়ু পরিবর্তন অভিবাসন ও বাস্তুচ্যুতির মূল প্রতিকূল চালিকা হিসেবে বিদ্যমান ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত নগরায়নকে তরান্বিত করে। জলবায়ুকেন্দ্রীক অভিবাসন মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশ এবং সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ তীব্রভাবে নেতিবাচক প্রভাব অনুভব করবে।
সোমবার ঢাকায় অবস্থিত ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জলবাযূ পরিবর্তন ও অভিবাসন বিষয়ক নীতি সংলাপে এসব কথা বলেন দেশী বিদেশি আলোচকরা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে।
এই সংলাপে সরকার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা অংশ নেন।
সংলাপের উদ্দেশ্য ছিল, জলবায়ু পরিবর্তন-অভিবাসন সংক্রান্ত বৈশ্বিক এজেন্ডাকে আরও গতিশীল করা। এছাড়া মিশরের শারম-এল-শেখ শহরে আসন্ন জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে অভিবাসন, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে যাতে বাংলাদেশ নেতৃত্বে দিতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করা।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ.কে. আবদুল মোমেন বলেন, জলবায়ু অভিবাসী ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গাফিলতি থাকা ঠিক না। তিনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতিধারা বজায় রাখার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য একটি শালীন জীবনযাত্রার অবস্থা গড়তে সরকার যে চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হচ্ছে, তা তুলে ধরেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের নিরলস কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ধীরে ধীরে জলবায়ু-সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ও প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ব্যবস্থা তৈরির মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মুখ খুলছে।
নীতি সংলাপের সূচনা বক্তব্যে পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন জলবায়ু পরিবর্তের কারণে সৃষ্ট অভিবাসন সমস্যা বিশ্বব্যাপী উত্থাপনে বাংলাদেশের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। পররাষ্ট্র সচিব জোর দিয়ে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের মতো দুর্বল দেশগুলোর পর্যাপ্ত অর্থ ও প্রযুক্তি প্রয়োজন । “
প্যারিস চুক্তির আলোকে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ২° সে. সেলসিয়াস-এর নিচে সীমিত করার লক্ষ্য পূরণের জন্য শক্তিশালী বৈশ্বিক পদক্ষেপের প্রয়োজন। সেই সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং নীতিগুলিতে জলবায়ু অভিবাসনকে একীভূত করা দরাকার।
সামগ্রিকভাবে, বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুত বাংলাদেশীদের সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে ১৩.৩ মিলিয়নে পৌঁছতে পারে। একইসাথে এটি অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের এক নম্বর কারণ হতে পারে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার তার উন্নয়ন পরিকল্পনা কাঠামোতে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করেছে।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে একটা ‘অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় জাতীয় কৌশল’ প্রণয়ন করেছে। দেশের সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সকল মূল নীতিমালায় জলবায়ু অভিবাসন একটি আলোচিত বিষয়; যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল এবং কার্যপরিকল্পনা (২০০৯), ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২১-২০২৫ এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা দশক ২০৩০।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, এম.পি., বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও অভিযোজনে সমন্বিত পদক্ষেপ, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতি ও পরিকল্পনা জলবায়ু অভিবাসন মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে৷ আজকে নেওয়া নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অভিবাসী এবং তাদের পরিবারের জন্য কতটা সহায়ক তা নির্ধারণ করবে।”
সংলাপ চলাকালীন আইওএম-এর মাইগ্রেশন অ্যান্ড ক্লাইমেট অ্যাকশনের বিশেষ দূত মিস ক্যারোলিন ডুমাস 'গ্লোবাল অ্যান্ড রিজিওনাল কনসালটেটিভ প্রসেস অ্যান্ড পলিসি ফ্রেমওয়ার্কস'-এর উপর একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এছাড়া ক্লাইমেট ব্রিজ ফান্ড সচিবালয়ের প্রধান গোলাম রব্বানী বাংলাদেশে ’জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবের প্রেক্ষাপটে মানব গতিশীলতা' বিষয়ে আরেকটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর ডেপুটি মহাপরিচালক উগোচি ডেনিয়েলস বলেন, “আইওএম অভিবাসন নীতিমালা এবং প্রায়গিক জ্ঞান সহায়তা প্রদানে বিশেষায়িত একটি প্রতিষ্ঠান। অভিবাসন, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল ২০২১-২০৩০ এর প্রতিফলন হিসেবে জলবায়ু অভিবাসন নিয়ে আইওএম আহ্বায়ক সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। জলবায়ু পরিবর্তনে যারা ইতোমধ্যে অভিবাসন করেছেন, করতে আগ্রহী এবং যারা অভিবাসন করেননি, সকলের জন্য সমাধান আনয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আইওএম।”
বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস বলেছেন, “জলবায়ু অভিবাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় বাংলাদেশে জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন সহায়ক অবকাঠামো (ইউএনএসডিসিএফ) ২০২২-২০২৬-এ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছে। জাতিসংঘ পরিবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।“
এছাড়াও, বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ; আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক জনাব সালিমুল হক; দুর্যোগ অভিবাসন প্লাটফর্ম সচিবালয়ের প্রধান জনাব এটেল সোলবার্গ এবং ইউএন উইমেন-এর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট মিস দিলরুবা হায়দার এই সংলাপে কথা বলেন।
সংলাপের সমাপনীতে, আইওএম বাংলাদেশ-এর মিশন প্রধান আব্দুসাত্তর এসোয়েভ জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ সরকার এবং অন্যান্য সকল অংশীদারদের সাথে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।