প্রধান শিক্ষক, রাজনীতিবীদ রশিদ মাস্টারের ঠাঁই এখন যাত্রী ছাউনীতে!

, জাতীয়

গনেশ দাস, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া | 2023-09-01 03:55:10

আব্দুর রশিদ মাস্টার (৮৮)। তিনটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন জেলা পরিষদ সদস্য এবং উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি। উপজেলা চেয়ারম্যান পদেও ভোট করেছেন দুই বার। রাজনীতি করেছেন এরশাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রী মামদুদুর রহমান চৌধুরীর সাথে। গ্রামে ছিল পুকুর, বাগানসহ বাড়ি, দেড় বিঘা জমির ওপর ছিল চাতাল। চাষাবাদের জমিও ছিল ৪ বিঘা। কিন্তু আজ তার কিছুই নেই। আর এ কারণে স্থান হয়নি স্ত্রী-সন্তানের কাছে। শেষ বয়সে  তিনি একাকী দিন-রাত কাটাচ্ছেন মহাসড়কের পার্শ্বে যাত্রী ছাউনিতে।

গত দেড় বছর যাবত তিনি যাত্রী ছাউনীতে পড়ে থাকলেও সহযোগিতায় এগিয়ে আসেননি স্থানীয় প্রশাসন কিংবা কোন জনপ্রতিনিধি।

রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) বগুড়া-নাটোর মহাসড়কে নন্দীগ্রাম উপজেলার কুন্দারহাট বাসস্ট্যান্ড যাত্রী ছাউনীতে দেখা হয় শিক্ষক আব্দুর রশিদের সাথে।

বয়সের ভারে স্মৃতি শক্তি লোপ পেলেও তার জীবনের অনেক কথাই এখন স্মরণ করেন। আব্দুর রশিদ ১৯৬২ সালে মেট্রিক পাশ করার পর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর শিক্ষায় স্নাতক (বিএড) কোর্স সম্পন্ন করে যোগ দেন নাটোরের সিংড়া উপজেলা সাতপুকুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে। সেখান থেকে চলে আসেন নন্দীগ্রাম উপজেলার বীজরুল উচ্চ বিদ্যালয়ে একই পদে। সর্বশেষ তিনি চাকরি করেন কুন্দারহাট ইনছান আলী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে।

নন্দীগ্রাম উপজেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি নাজির আহম্মেদ বলেন, ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে নন্দীগ্রাম উপজেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ওই সময় বগুড়া জেলা পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন রশিদ মাস্টার। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করেছেন দুইবার।

আব্দুর রশিদ মাস্টারের ছোট ভাই জিল্লুর রহমান জলিল বলেন, রাজনীতি ও নির্বাচন করতে গিয়ে রশিদ মাস্টার ৪ বিঘা আবদী জমি বিক্রি করেন অনেক আগেই। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ছিল তার সুখের সংসার। মেয়ে মরিয়মকে বিয়ে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী সিংড়া উপজেলায়। একমাত্র ছেলে মোন্নাফ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর আব্দুর রশিদ মাস্টার বগুড়া শহরে ২য় বিয়ে করে শহরেই বসবাস শুরু করেন। ২য় স্ত্রীর ঘরে একটি মেয়ে সন্তান জন্ম গ্রহণ করার পর স্ত্রী ও শ্বাশুড়ি চাপ দিয়ে বাড়ি, পুকুর-বাগানসহ দেড় বিঘা জমি লিখে নেন। মহাসড়কের পার্শ্বে মূল্যবান দেড় বিঘা জমির উপর ধান শুকানো চাতালটি আব্দুর রশিদ মাস্টার লিখে দেন বড় বোন আমিনাকে। বোনের সাথে মৌখিক শর্ত ছিল স্ত্রী সন্তান না দেখলে শেষ বয়সে বোনের ছেলে-মেয়ে রশিদ মাস্টারের ভরন পোষণের দায়িত্ব নিবেন। কিন্তু বড় বোন মারা যাওয়ার  পর তার ছেলে মেয়েরা কোন খোঁজ খবর রাখে না রশিদ মাস্টারের।

এদিকে ২য় স্ত্রীও মেয়ে তাদের নামে লিখে নেয়া বাড়িসহ পুকুর বাগান বিক্রি করে দেন রশিদ মাস্টারের ভাতিজা রায়হানের কাছে। বছর দুই আগে ২য় স্ত্রী ও মেয়ে রশিদ মাস্টারকে বগুড়া শহরের বাড়ি থেকে বের করে দিলে তিনি চলে আসেন গ্রামের বাড়ি নন্দীগ্রাম উপজেলা ভাটগ্রামে। কিন্তু  সেখানে ঠাঁই হয় না তার। এরপর রশিদ মাস্টার কুন্দারহাট বাজারে একটি বট গাছের নিচে আশ্রয় নেন। সেখানেই কাটতে থাকে তার দিন। মানুষের কাছে হাত পেতে খাবার জোটে তার। একপর্যায় মহাসড়ক সম্প্রসারণ কাজে বটগাছটি কাটা পড়লে রশিদ মাস্টার আশ্রয় নেন যাত্রী ছাউনীতে।

স্থানীয়রা বলেন, ভাই ভাতিজা এবং ১ম স্ত্রীর মেয়েকে সম্পত্তির ভাগ থেকে বঞ্চিত করায় তারা রশিদ মাস্টারের খবর নেন না। ছোট ভাই জলিলও স্ত্রী ও ছেলের চাপে বড় ভাইকে বাড়িতে জায়গা দিতে পারছেন না। এ কারণে যাত্রী ছাউনীতে পড়ে আছেন রশিদ মাস্টার।

কুন্দারহাট বাস স্ট্যান্ডের চেইন মাস্টার আব্দুল বাছেদ বলেন, গত দেড় বছর ধরে যাত্রী সাধারন যাত্রী ছাউনীটি ব্যবহার করতে পারছেন না। রশিদ মাস্টার নিজে চলাফেরা করতে না পারার কারণে সেখানেই মল মূত্র ত্যাগ করেন। এ কারণে দুর্গন্ধে যাত্রী ছাউনীতে প্রবেশ করা যায় না। রশিদ মাস্টারকে এলাকার সবাই চেনার কারণে কেউ কিছু বলেন না।

রশিদ মাস্টারের ছোট ভাই আব্দুল জলিল বলেন, আমি বাড়িতে জায়গা দিতে না পারলেও প্রতিদিন হোটেল থেকে খাবার কিনে দেই। তিনি বলেন আমিও নিরূপায়। নিজের বড় ভাই চোখের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে, কিন্তু বাড়িতে নিয়ে যেতে পারছি না। এটা আমার জন্য কতটা কষ্টের তা কেউ বুঝবে না।

স্থানীয় সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, রশিদ মাস্টার এলাকার একজন সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন।  তার এই অবস্থা আমাকে কেউ কোন বলেনি।  আমি অবশ্যই তাকে সহযোগিতা করবো। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে রশিদ মাস্টারকে ঘর বন্দোবস্ত দেয়া  হবে বলে সংসদ সদস্য জানান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর