একমাত্র অবলম্বন ছিলেন শান্তিরক্ষায় নিহত সেনা সদস্য শরিফ

, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিরাজগঞ্জ | 2023-08-30 20:28:24

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে আফ্রিকায় পেশাগত দায়িত্ব পালনে টহলরত গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় অকালে প্রাণ হারিয়েছেন সিরাজগঞ্জের বেলকুচির সৈনিক শরীফ হোসেন (২৬)। চাকরি পাওয়ায় পর পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন শরীফ। নিহতের খবর শুনে বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

মিশন থেকে ফিরে ছোট বোনকে বিয়ে দিবেন। কিন্তু সে আশা আর পূরণ হলো না শান্তিরক্ষায় অংশ নেওয়া সেনা সদস্য শরীফ হোসেনের। নিহতের খবর পেয়ে স্তব্ধ শরীফের পরিবার। কাঁদতে কাঁদতে যেন চোখের পানি শুকিয়ে গেছে তার বাবা-মা, ভাইবোন ও স্ত্রীসহ স্বজনদের। এখন তারা শরীফের লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন।

মিশনে নিহত শরীফ হোসেনের বাড়ি উপজেলা সদরের বেড়াখাড়ুয়া গ্রামের লেবু তালুকদারের ছেলে। মা-বাবা, দুই ভাই এক বোন ও শরীফের স্ত্রীসহ পাঁচজনের সদস্য।

বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) সকালে নিহত শরীফের ছোট ভাই কাউসার তালুকার এতথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে, গত মঙ্গলবার মোবাইলের মাধ্যমে শরীফের মৃত্যুর খবর পরিবারকে জানানো হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ছেলের মৃত্যুতে শোকে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তার মা পাঞ্জু আরা বেগম। কথাবলার ভাষা নেই বাবা লেবু শেখের। কাঁদতে কাঁদতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন ভাই, বোন ও স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরা। ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন শরীফের বাবা-মা। মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলেছেন, তোমরা শুধু আমার ছেলেকে এনে দাও। এভাবে আমাদের আগে শরীফ চলে যেতে পারে না। এই বয়সে ছেলে এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে কোন দিন ভাবি নাই।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অন্যের বাড়িতে সুতার কারিগর হিসেবে কাজ করে এবং দর্জির কাজ করে শরিফকে বড় করেছিলেন তার মা। শরিফ চাকরি পাওয়ায় পর পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন তিনি। বর্তমানে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন শরীফ। বাবা ছিলেন তাঁত শ্রমিক। ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। মিশনে যাওয়ার ৬ মাস আগে বিয়ে করেছেন শরীফ। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে শরীফ সবার বড়। পরিবারে চলছে বোনের বিয়ের কথা। মিশন থেকে ফিরে একমাত্র ছোট বোন লাকী খাতুনের বিয়ে। কিন্তু মৃত্যুর খবর শুনে শোকে পরিবারটি এখন স্তব্ধ।

নিহত সেনা সদস্য শরীফ হোসেনের ছোট ভাই কাউসার তালুকদার বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আমার ভাই নিহত হয়েছে এই খবর মঙ্গলবার রাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে আমাদের জানানো হয়। খবরটা শুনে আমার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খবর শোনার পর থেকে বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করছে। আমার ভাই আমাদের একমাত্র উপার্জনের সম্বল ছিল। আমার বোনের বিয়ের কথা চলছে। ভাই বলেছে বোনের বিয়ে দিতে যত টাকা লাগে আমি দেব। পরিবারের কারও চিন্তা করার দরকার নেই। আমি মিশন থেকে ফিরে বিয়ে দেব। সেই ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই। এখন আমাদের কী হবে। ভাই আমাদের সংসার চালাতো।


নিহত সেনা সদস্য শরীফ হোসেনের বাবা লেবু শেখ তালুকদার বলেন, আমি তাঁত শ্রমিকের কাজ করতাম। আমার স্ত্রী অন্যের বাড়ি থেকে সুতার কাজ করতো। ছেলের চাকরি হওয়ার পর থেকে আমাদের কোনো কাজ করতে দিতো না। ছেলেই সংসার চালাতো। তার চাকরির টাকা দিয়ে সংসারের সব খরচ চলছিল। কিন্তু মিশনে যাওয়ার ৬ মাস আগে ছেলেকে বিয়ে করাই। আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। এত অল্প বয়সে ছেলে এভাবে চলে যাবে কোনো দিন ভাবিনি।

নিহত শরীফের প্রতিবেশী পারভেজ ও হাসান শেখ বলেন, শরীফ মৃধাবী ও ভালো একজন ছেলে ছিল। সবার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলত। অল্প বয়সে তার মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। আমরা ভালো একজন ছেলে হারালাম। শরীফ শুধু বেলকুচির না সারা দেশের হয়ে জীবন দিয়েছে। এটা এলাকার মানুষ হিসেবে আমাদের গর্ব।

বেলকুচি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সাজেদুল বলেন, শরীফ নিহত হওয়ার খবর শুনে আমি তাদের পরিবারের খোঁজ খবর নেই। শরীফ অত্যন্ত ভালো একটি পরিবারের ছেলে ছিল। সে আমাদের বেলকুচির গর্ব।

বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনিছুর রহমান বলেন, শান্তিরক্ষা মিশনে শরীফের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। মৃত্যুর খবর পেয়ে নিহত শরীফের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারকে শান্তা দেওয়া চেষ্টা করেছি। কিন্তু একমাত্র উপার্জনের ছেলেকে হারিয়ে পরিবারটি শোকে স্তব্ধ। লাশ দেশে আনাসহ সব বিষয়ে নিহতের পরিবারকে সহযোগিতা করা হবে।

প্রসঙ্গত, গত (৩ অক্টোবর) সোমবার রাত ৮টার পর মধ্য আফ্রিকায় শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সময় ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের (আইইডি) বিস্ফোরণে শরীফ হোসেনসহ (২৬) তিন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হন। নিহত শান্তিরক্ষীরা হলেন- সৈনিক শরিফ হোসেন, সৈনিক জসিম উদ্দিন (৩১, সেনিক জাহাঙ্গীর আলম (২৬)।

এ সম্পর্কিত আরও খবর