আজ হানাদারমুক্ত হয় সাতক্ষীরার কলারোয়া ও দেবহাটায়

খুলনা, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 05:59:11

আজ ৬ ডিসেম্বর। সাতক্ষীরার ‘কলারোয়া ও দেবহাটা হানাদারমুক্ত’ দিবস। একাত্তরের অগ্নিঝরা এই দিনে কলারোয়া ও দেবহাটা এলাকা পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। সাতক্ষীরা এ দুই উপজেলার আকাশে ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

আজ বৃহস্পতিবার গৌরবোজ্জ্বল এ দিবসটি এবারও পালিত হচ্ছে যথাযোগ্য মর্যাদায়। সূত্রমতে, মহান মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়ার ৩৪৩ জন বীর সন্তান অংশ নেন বলে জানা যায়। এরমধ্যে শহীদ হন ২৭ জন বীর সৈনিক। কলারোয়া অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রবাসী সংগ্রাম পরিষদ। কলারোয়া এলাকা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে ৮নং সেক্টরের অধীন। একাত্তরে কলারোয়া এলাকায় পাক-বাহিনীর আক্রমণে সর্বপ্রথমে শহীদ হন মাহমুদপুর গ্রামের আফছার সরদার। এরপর এপ্রিলে পাকবাহিনী কলারোয়ার পালপাড়ায় হামলা চালিয়ে গুলি করে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করে ৯ জন কুম্ভকারকে।

পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ পরিচালনা করেন কলারোয়ার ২ বীর যোদ্ধা কমান্ডার মোসলেম উদ্দীন ও আব্দুল গফফার। সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে সংঘটিত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৬ শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়।

বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা যায়, কলারোয়ায় পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এরমধ্যে ১৮ সেপ্টেম্বরের বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এই যুদ্ধে ২৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। শহীদ হন ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া ১৭ সেপ্টেম্বর কলারোয়ার কাকডাঙ্গার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনারা বাধ্য হয় কাকডাঙ্গা ঘাঁটি ছাড়তে। এর আগে ২৭ আগস্ট সমগ্র চন্দনপুর এলাকা পাকবাহিনী মুক্ত হয়। অক্টোবরের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা কলারোয়ার পার্শ্ববর্তী বাগআঁচড়ায় দুঃসাহসিক হামলা চালিয়ে ৭ জন পাক রেঞ্জারকে হত্যা করেন। খোরদো এলাকাও বীরযোদ্ধারা পাক বাহিনী মুক্ত করে ফেলেন। কলারোয়ার বীরযোদ্ধাদের ধারাবাহিক সফল অপারেশনের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাক বাহিনী। পাক হানাদাররা যখন বুঝতে পারলো যে তাদের পরাজয় নিশ্চিত ও আসন্ন তখন তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা করে।

এরই অংশ হিসেবে ৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে কলারোয়ার বেত্রবতী নদীর ব্রিজ মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়ে পাকসেনারা পালিয়ে যায়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাযোগে নদী পার হয়ে এসে কলারোয়া বাজার নিয়ন্ত্রণে নেন। এভাবে একেকটি সফল অপারেশনের মধ্য দিয়ে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর কবল থেকে কলারোয়ার পবিত্র মাটিকে মুক্ত করেছিলেন আজকের এই দিনে।

কলারোয়া থানা চত্বরে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে সবুজের বুকে রক্তসূর্য খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান মুক্তিকামী বীরযোদ্ধা ও জনতা। শুধু মুক্তিযোদ্ধারা নন কলারোয়ার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের কথা মানুষের স্মৃতিপটে আজও অমলীন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি তাঁদের প্রতিও জাতি জানায়, সশ্রদ্ধ সালাম ও কৃতজ্ঞতা। তাঁরা হলেন: সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রয়াত মমতাজ আহমদে, তাঁর ভাই শহিদ এসএম এন্তাজ আলি, স্বর্গীয় শ্যামাপদ শেঠ, ভাষা সৈনিক প্রয়াত শেখ আমানুল্লাহ, বিএম নজরুল ইসলামসহ অনেকেই। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও সংগঠকদের সুচিন্তিত দিক নির্দেশনায় অবশেষে কলারোয়ার পবিত্র ভূমি পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর।

আজ বৃহস্পতিবার দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কলারোয়া উপজেলা কমান্ড গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে: সকাল ৮টায় জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পতাকা উত্তোলন, সকাল ৮-১৫ মিনিটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সাড়ে ৮টায় গণকবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ, সকাল ১০টায় একাত্তরের রণাঙ্গনের বেশে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার বর্ণাঢ্য বিজয় র‌্যালি, বেলা ১১টায় উপজেলা পরিষদ চত্বরে পাক হানাদারমুক্ত দিবসের আলোচনা সভা। সমগ্র কর্মসূচিতে কলারোয়ার মুক্তিকামী সর্বস্তরের জনতাকে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার গোলাম মোস্তফা।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাঁথা ৬ ডিসেম্বর দেবহাটা মুক্ত দিবস উপলক্ষে অনুরূপ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাঁথা এই দিনে দেবহাটা উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিলো, উড়েছিল বিজয়ের পতাকা। পাক হানাদার মুক্ত হয়ে সমগ্র এলাকার মানুষের মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছিলো। এই দিনে দেবহাটার মানুষ খুঁজে পেয়েছিল দীর্ঘদিনের যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে এই দিনটিকে স্মরণ করে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সকালে র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই সকল কর্মসূচীতে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল ও সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের সেই ঐতিহাসিক দিনগুলোর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, সমগ্র দেবহাটা ছিল ৯ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। এই ৯ নং সেক্টরের আওতায় ৩টি সাব-সেক্টর গঠন করা হয়। তার মধ্যে প্রথম সেক্টরটি ছিল শমসের নগর। যার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা। দ্বিতীয়টি হেঙ্গলগজ্ঞ ও তৃতীয়টি ছিল টাকী। যার নেতৃত্বে ছিলেন মরহুম ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। বাংলাদেশের ১১ টি সেক্টরের মধ্যে ৯নং সেক্টরটি ছিল সর্ববৃহৎ। ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের উদ্যোগেই ভারতের টাকীতে গড়ে তোলা হয় ৯নং সেক্টর। সেজন্য তাকে ৯নং সেক্টরের প্রতিষ্ঠাতা ও সাব সেক্টর কমান্ডারের খেতাব দেয়া হয়। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল।

শাহজাহান মাষ্টারের নেতৃত্বেই এই অঞ্চলের যুবকেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন দেবহাটা এলাকার খানজিয়া ক্যাম্প, দেবহাটা ক্যাম্প, টাউনশ্রীপুর ক্যাম্প, সখিপুর ক্যাম্প, পারুলিয়া ক্যাম্প, কুলিয়া বাজার ও পুষ্পকাটি ইটের ভাটাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাক সেনারা ঘাঁটি গড়ে তোলে। দেবহাটা এলাকায় টাউনশ্রীপুর ফুটবল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক সেনাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর এক রাজাকার পাক সেনাদের কাছে পৌঁছে দেয়। ফলে পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। বিষয়টি ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার বুঝতে পেরে অসীম সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে পাক সেনারা পরাস্থ হয়। এই যুদ্ধে বহু পাক সেনা নিহত হয়।

এই যুদ্ধ ছাড়াও ভাতশালা সহ বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মরহুম ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। ভাতশালা যুদ্ধের শেষের দিকে হঠাৎ একটি বুলেট এসে মুক্তিযোদ্ধা গোলজারের মাথায় লাগে। সেখানেই তিনি নিহত হন। একপর্যায়ে টাউনশ্রীপুরের সেনা ঘাটির পতন হয়। তখন প্রধান সেনাপতি এম.এ জি ওসমানী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও সেক্টর কমান্ডার এম.এ জলিল সকলে মিলে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারকে নিয়ে বিজয় উল্লাস করেন। এখান থেকে পাক সেনারা যাওয়ার সময় শাহজাহান মাষ্টারের বাড়ি কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এরপরে অক্টোবর মাসে খান সেনারা খাঁনজিয়া ক্যাম্প ছেড়ে পলায়ন করে। তারা যাওয়ার সময় ঐ এলাকায় এ.পি মাইন পুতে রেখে যায়। ঐ মাইনগুলো অপসারণ করতে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব শহীদ হন। পরে পারুলিয়া, সখিপুর ও কুলিয়া সহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধে পাক সেনারা পরাস্থ হয়। তারা চলে যাওয়ার সময় বহু মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং পারুলিয়া ব্রিজ ধ্বংস করে দেয়। এভাবে দেবহাটা উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয় ও ওঠে বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা। সেই দিনটিকে স্মরণ করে দেবহাটা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর